ক্যাসিনো-পণ্য সহজেই আসে

>
উদ্ধার করা ক্যাসিনো সামগ্রী।  ফাইল ছবি
উদ্ধার করা ক্যাসিনো সামগ্রী। ফাইল ছবি
নানা ধরনের পণ্যের চালানে একটি-দুটি করে ক্যাসিনোর স্লট মেশিন, পোকার সেট, টেবিল, চিপসসহ বিভিন্ন ক্যাসিনো সরঞ্জাম আমদানি করা হয়

দেশে ক্যাসিনোর সরঞ্জামাদি আনা গেছে খুব সহজেই। অনেকে কৌশল করেছেন, এনেছেন অন্য পণ্যের আড়ালে। আবার কেউ কেউ এনেছেন সরাসরি, নিয়মনীতি মেনেই। কেননা, আমদানিনীতিতে আমদানি–নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি নেই। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, হাতে গোনা কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খেলার সামগ্রী হিসেবে ঘোষণা দিয়েই ক্যাসিনোর টেবিল ও যন্ত্রপাতি এনেছে। আবার একটি-দুটি করে স্লট মেশিন, পোকার সেট, মহজং টেবিল, চিপস—এ রকম অনেক পণ্য এসেছে নানা ধরনের পণ্যের চালানের আড়ালে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব আনা হয়েছে চীন থেকে। রাজধানীর কমলাপুর অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়েই মূলত এসব পণ্য খালাস করা হয়েছে। 

ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে এমন ছয়টি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সিক্স সি করপোরেশন, নিনাদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, বেস্ট টাইকুন এন্টারপ্রাইজ, নিউ হোপ অ্যাগ্রোটেক লিমিটেড, পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ ও এবি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। সরেজমিনে দেখা গেছে, অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দারা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের খোঁজে নেমেছেন। 

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি আমদানিকারকের বিল অব এন্ট্রি পরীক্ষা করে জুয়ার মেশিন আমদানির প্রাথমিক তথ্য পেয়েছি। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের খুঁজে বের করা হচ্ছে। এতে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে কারা জড়িত, তা জানা যাবে। ইতিমধ্যে নানামুখী গোয়েন্দা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হলে তা আদায় করা হবে।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের আমদানিনীতিতে আমদানিনিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত আমদানি পণ্যের তালিকায় ক্যাসিনোতে ব্যবহার করা হয়, এমন পণ্যের নাম নেই। সুতরাং ক্যাসিনোতে ব্যবহার করা হয়, এমন মেশিন ও সামগ্রী আমদানিনিষিদ্ধ নয়। নতুন নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান নীতিমালাই অনুসরণ করছে এনবিআর। আমদানিতে ব্যবহার করা হয়েছে ৯৫০৪৯০০০ এইচএস কোড। এই কোডে সাধারণত ভিডিও গেমস, বিলিয়ার্ড টেবিল, বোলিং যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। প্রতিটি এইচএস কোডে ‘অন্যান্য’ নামে এ সুযোগ থাকে। জুয়ার যন্ত্রপাতি আমদানিতে ‘অন্যান্য’-এর সুযোগ নেওয়া হয়েছে। 

আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের প্রধান অনুপ কুমার সাহা গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে জানান, আমদানিনীতি আদেশে নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পণ্যের তালিকায় ক্যাসিনোর সরঞ্জামাদির কথা নেই। এ আদেশ অনুযায়ী, এটি আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য নয়। 

যেভাবে আমদানি হয়

রাজধানীর নয়াপল্টনের সিক্স সি করপোরেশন নামের প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে চারটি চালানের মাধ্যমে চীন থেকে স্পোর্টস টেবিল, গেম মেশিন, মহজং টেবিল আনে। এসব মেশিন ও টেবিল জুয়া খেলায় ব্যবহৃত হয়।

২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল কমলাপুর আইসিডিতে সিক্স সি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দাখিল করা বিল অব এন্ট্রিতে প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ১২ নয়াপল্টন (চতুর্থ তলা, রুম-এ ফোর), নগর প্রোপার্টি, ঢাকা। ওই চালানে জুয়ার মেশিনের পাশাপাশি ছিল স্প্রে মেশিন, ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি, গাড়ির সংকেতবাতি, নিরাপত্তা সেন্সর ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি। ওই চালানে দুটি স্পোর্টস টেবিল ছিল, যা জুয়ার বোর্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। টেবিল দুটির শুল্ক-কর বাদে দাম ধরা হয় ১৯ হাজার ১৬৩ ডলার। 

একই বছরের ১০ এপ্রিল সিক্স সি আরেকটি চালানে ২০টি গেম মেশিন আমদানি করে। ওই গেম মেশিনের আমদানিমূল্য ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ১২০ ডলার। পরের মাসে আরেকটি চালানে আরও দুটি গেম মেশিন এবং একই বছরের নভেম্বর মাসে সিক্স সি মেডিকেল যন্ত্রপাতির আড়ালে দুটি মহজং টেবিল নামে জুয়ার টেবিল আনে। ওই দুটি পণ্যের দাম ৩৩ হাজার ৩৩৪ ডলার।

গতকাল বুধবার সিক্স সি করপোরেশনের ঠিকানায় গিয়ে ট্রেড লিংক নামের একটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে। এ প্রতিষ্ঠান সিক্স সি করপোরেশনের লাইসেন্স ব্যবহার করে ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক দেওয়ান মো. এ রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, এসব যন্ত্রপাতি আমদানিনিষিদ্ধ নয়। আমদানিকালে শুল্ক কর্তৃপক্ষও কোনো আপত্তি করেনি।

এ ছাড়া নিনাদ ইন্টারন্যাশনাল গত বছরের ৬ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মাধ্যমে দুটি মহজং টেবিল খালাস করে। টেবিল দুটির দাম পড়ে ৩০ হাজার ৩৫৬ ডলার। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যের চালানটি খালাস করেছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান অ্যানি অ্যান্ড কোং। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শাহজাদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এ চালান খালাসের পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। তবে বৈধ পণ্য হিসেবেই আমদানি হয়েছে।

রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের একটি ঠিকানা ব্যবহার করেছে নিনাদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। গতকাল গিয়ে দেখা গেছে, ওই ঠিকানায় এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এটি একজন আইনজীবীর বাড়ি।

বেস্ট টাইকুন এন্টারপ্রাইজের ঠিকানা হলো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতার আয়তলা গ্রাম। এ বছরের ২৬ মে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে একটি মহজং টেবিল খালাস করা হয়। আমদানিমূল্য ২৬ হাজার ৭০৬ ডলার। চট্টগ্রামের চকবাজারের কেবি আমান আলী রোডে অবস্থিত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান মমতা ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড আমদানিকারকের পক্ষে এ চালান খালাস করেছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এস এম নাজমুল আলম আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোকে জানান, বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত মোবাইল ফোন কারখানার জন্য ওই সব পণ্য আমদানি করেছে। এসব পণ্য জুয়া খেলার জন্য নয়, কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে। 

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার চর বাউশিয়ার নিউ হোপ অ্যাগ্রোটেক প্রতিষ্ঠানটি পশুখাদ্য, রাবার বেল্ট, গাড়ির ইঞ্জিন অয়েল ফিল্টার, কনভেয়ারসহ ১৩টি পণ্যের চালানে জুয়ার টেবিল আনা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে তিনটি মহজং টেবিল খালাস করে। তিনটি টেবিলের আমদানিমূল্য ৯৭ হাজার ২৬৮ ডলার।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এম এন ট্রেড কিং এ চালান খালাস করে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টটির কর্ণধার মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, চীনা বিনিয়োগে স্থাপিত পোলট্রি ফিড কারখানার পক্ষে পণ্যটি এসেছে। কী প্রয়োজনে আনা হয়েছে, তা আমদানিকারকই জানবে। 

এ ছাড়া দক্ষিণ কমলাপুরের পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ ও মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের এবি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন সময়ে কমলাপুর আইসিডি ও বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে রুলেট মেশিন, পোকার টেবিল ও সেট এবং চিপস খালাস করেছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, একটি চালানে নারীদের জুতার সৌন্দর্য বাড়ানোর সামগ্রী আমদানির নামে জুয়ার চিপস এসেছে। 

 নথিতে পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজের জন্য দক্ষিণ কমলাপুরের একটি ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজের পরিবর্তে সরকার ট্রেড এজেন্সি নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে এ বন্দর দিয়ে বিভিন্ন পণ্যের ভিড়ে ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতির ১৫টি চালান খালাস করা হয়েছে। এর ১৩টি চালান আনা হয়েছে চীন থেকে। একটি করে জাপান ও হংকং থেকে আনা হয়। এ ১৫ চালানে ৩৪৯ ধরনের সরঞ্জাম ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি আনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আরও আছে অ্যামিগো বাংলাদেশ, বেস্ট টাইকুন এন্টারপ্রাইজ, চায়না কমিউনিকেশনস, ডংজিং লংজারভিটি ইন্ডাস্ট্রি, ফার্স্ট রেস কোম্পানি, মেসার্স বিবি ইন্টারন্যাশনাল, মিন মাও হার্ডওয়্যার, মুন ট্রেডিং, ওসজি জয়েন্টভেঞ্চার ও যাহিন ইন্টেরিয়র কম্পোনেন্টস। 

এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদউদ্দিন গতকাল বুধবার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিনীতিতে এসব পণ্য নিষিদ্ধ বা শর্ত সাপেক্ষে আমদানি পণ্যের তালিকায় ছিল না। তাই এ ধরনের পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে এনবিআরের ভূমিকা রাখার সুযোগ কম। যখন এ ধরনের তালিকা তৈরি করা হয়, তখন বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত করা হয়। তখন আপত্তি দেওয়া হয়নি কেন?

মো. ফরিদউদ্দিনের মতে, দেশের মধ্যে এত এত ক্যাসিনো চললেও কেন এত দিন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এসব বিষয় নিয়েও এখন প্রশ্ন তোলা উচিত।

 সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম আমদানিনিষিদ্ধ না হওয়ার সুযোগটিই নিয়েছে সব পক্ষ। বৈধ উপায়ে ঘোষণা দিয়ে শুল্ক-কর পরিশোধ করে এসব সরঞ্জাম নানা হাত ঘুরে ক্যাসিনোগুলোতে পৌঁছায়। ফলে এসব পণ্য আমদানির তথ্য যেমন এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জানা ছিল, তেমনি ক্যাসিনো পরিচালনার সংবাদও পুলিশসহ কারও অজানা ছিল না। কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন ক্যাসিনোতে অভিযানের পর বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। আবার ক্যাসিনোগুলোতে জুয়া খেলা ছাড়াও নানা ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের খবরও প্রচার পাচ্ছে। কূটনীতিক ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের (বিদেশি সংস্থায় কর্মরত) জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদও এসব জায়গায় গেছে। সব মিলিয়ে আইনি দুর্বলতা, নজরদারির অভাব এবং বিশেষ সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি নতুন করে আবারও আলোচনায় এসেছে।