ক্ষমতায় থাকলে এক, বাইরে আরেক

দেড় যুগ ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।

দেশে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপকতা পায় ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে র‌্যাব গঠনের পর। এর আগে ২০০২ সালে ‘অপারেশন ক্লিনহার্টের’ সময় ৫৭ জন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মারা যান। তখন এসব মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছিল ‘হার্ট অ্যাটাক’। এরপর দেড় যুগ ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার, হারকিউলিস—এমন নানা নামে এটা চলছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ ও ২০০৪ সালে শুরু হওয়া ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করে ২০০২-০৬ সাল পর্যন্ত বক্তব্য রেখেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে নিজেদের অঙ্গীকারের কথা জানায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সরকার গঠন করে তারা বিষয়টি ভুলে যায়।

২০১১ সালের জানুয়ারিতে লন্ডনের অক্সফোর্ড ইউনিয়নে বিশ্বশান্তির ওপর বক্তব্য রাখার সময় এক ছাত্র বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করেছিলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমাদের সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। বরং সরকার এ ধরনের হত্যাকাণ্ড থামানোর চেষ্টা করছে।’

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে দেড় হাজারের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

ক্রসফায়ার শুরুটা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। তাই দলটি এর বিরুদ্ধে প্রথম দিকে কোনো অবস্থান নেয়নি। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী গুম বা ক্রসফায়ারের শিকার হন। এরপরই দলটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে। এমনকি গুম-ক্রসফায়ার বেড়ে গেলে র‌্যাব বিলুপ্ত করে দেওয়ার দাবিও তুলেছিলেন খালেদা জিয়া।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘দিন বদলের সনদ’ নামে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করে, ক্ষমতা পেলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। তবে সরকার গঠনের পর ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩৮০ জন ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে করা ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ করেনি আওয়ামী লীগ। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের পরবর্তী ৫ বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ৯৭১ জন নিহত হন।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের বিষয়টি উল্লেখ করেনি আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৮ সালের মে থেকে পরের এক বছরে শুধু মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৫৮ জন মারা যান। সর্বশেষ ৩১ জুলাই ঈদের আগের রাতে কক্সবাজারের টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যুর পর বন্দুকযুদ্ধ বন্ধের দাবি ওঠে নানা মহল থেকে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দল সব সময়ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তদন্ত হোক, সেটা চায় দল। আর তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে তাঁরা।

অন্যদিকে বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিনা বিচারে হত্যার বিষয়টি উল্লেখই করেনি। এ বিষয়ে তাদের অঙ্গীকারও ছিল না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি যে ইশতেহার ঘোষণা করে, তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘মামলা-হামলা, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কথা তুলে ধরা হয়। নির্বাচনে জয়ী হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে তারা।

বন্ধুকযুদ্ধের পক্ষে সংসদে বক্তব্য

বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে সাংসদদের সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। বরং গত এক দশকে সরকার ও বিরোধী দলের কয়েক জন সাংসদ সংসদে দাঁড়িয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে বক্তৃতা করেছেন।

সর্বশেষ গত ৮ জুলাই বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ রিজেন্ট হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এর মালিক মো. সাহেদকে ক্রসফয়ারে দেওয়ার দাবি করেন। সংসদে তিনি বলেন, মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে, তাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত নয়। ক্রসফায়ারে দেওয়া উচিত।

রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হলে গত ১৪ জানুয়ারি ক্রসফায়ার নিয়ে সংসদে কথা হয়। সেদিন জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছিলেন, ১০–১২টি ক্রসফায়ার ঘটলেই ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে। সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে ক্রসফায়ারে যেতেই হবে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে সমাজ কি হতাশ?

নাগরিকদের অনেকে ফেসবুকে নানা বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানান। পণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে, দুর্নীতি বন্ধে, ছিনতাই-রাহাজানি-হত্যা-সন্ত্রাস বন্ধে অনেকে ক্রসফায়ারের দাবি করেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রভাব হিসেবে দেখে থাকে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি যেভাবেই হোক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিতে পেরেছে। তারা একটা বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে যে কম সময়ে শান্তিশৃঙ্খলা আনতে বিচারবহির্ভূত হত্যা দরকার। এটা ভুল ধারণা।
মো. নূর খান, মানবাধিকার কর্মী

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি যেভাবেই হোক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিতে পেরেছে। তারা একটা বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে যে কম সময়ে শান্তিশৃঙ্খলা আনতে বিচারবহির্ভূত হত্যা দরকার। এটা ভুল ধারণা।