খুনিকে চিনে ফেলাই কাল হলো শিশুদের
বাসায় ঢুকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তিনটি ঘটনায় গত আড়াই বছরে চট্টগ্রাম নগরে চার শিশু খুন হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ নালাপাড়ার একটি ফ্ল্যাটে মায়ের সঙ্গে খুন হয়েছে আট বছরের শিশু রিয়া আক্তার। পুলিশ বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খুনিরা ওই সব পরিবারের পূর্বপরিচিত হওয়ায় ও ধরা পড়ার ভয়ে শিশুদেরও হত্যা করছে।
২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটায় নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় নিজ বাসায় খুন হন ডলি আক্তার ও তাঁর দুই সন্তান আলবী ও আদিবা। নয় বছর বয়সী আলবী বহদ্দারহাট সাইমন লাইট গ্রামার স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র এবং আদিবা (৫) একই স্কুলের নার্সারি শাখার শিক্ষার্থী ছিল।
গত বছরের ২৪ মার্চ আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার একটি বাসায় ঢুকে মেয়ে সায়মা নাজনীন ও মা রিজিয়া বেগমকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। নিহত সায়মা নাজনীন আগ্রাবাদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।
সর্বশেষ খুন হওয়া শিশু রিয়া মাদারবাড়ি বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার জানান, খুনিরা পূর্বপরিচিত হওয়ায় নিজেরা ধরা পড়ার ভয়ে শিশুদের খুন করতে পারে। বহদ্দারহাটে দুই শিশুসহ এক নারীকে খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার গৃহশিক্ষক তারেক চৌধুরী ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, শিশুরা তাঁকে চেনে। তাই মায়ের সঙ্গে তাদেরও খুন করা হয়।
মায়ের সঙ্গে শিশুদেরও কেন হত্যা করা হচ্ছে, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীও বলেন, ‘খুনিদের চিনে ফেলায় আতঙ্কের কারণে তারা শিশুদের খুন করে। এ ছাড়া প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকেও শিশুদের খুন করা হতে পারে। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে কীভাবে খুনের ঘটনায় নিজেকে আড়াল করা যায় এবং কীভাবে খুনিরা শনাক্ত হয়, তা দেখেও প্রমাণ না রাখতে শিশুদের খুন করতে পারে।’ তিনি জানান, সামাজিক অবক্ষয়, মানুষের মধ্যে অস্থিরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, অপরাধীরা আইনের আওতায় না আসায় এসব খুনের ঘটনা বাড়ছে।
গত ১০ জানুয়ারি বাসার সামনে গলির মুখে চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অঞ্জলী দেবীকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেলেও কারা, কী কারণে তাঁকে হত্যা করেছে, তা এখনো বের করতে পারেনি পুলিশ।
গত ১১ মার্চ লালখান বাজার হাইলেভেল রোডের বাসায় গৃহবধূ রুমা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহত রুমার ভাই বাদী হয়ে দেবর ইয়াকুবকে আসামি করে মামলা করেন। খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত চক্রবর্তী জানান, আসামি ইয়াকুবকে গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে।
মাসহ দুই শিশু এবং মা-মেয়েকে খুনের ঘটনার দুটি মামলা চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে গত জানুয়ারি মাসে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে দুটি মামলা।
নিহত ডলি আক্তারের বাবা মোহাম্মদ ইসহাক আক্ষেপ করে জানান, আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও নৃশংস তিন খুনের বিচার পাননি তিনি।
আগ্রাবাদে মা-মেয়ে হত্যা মামলার বাদী নিহত রিজিয়া বেগমের স্বামী ব্যবসায়ী রেজাউল করিম জানান, বখাটে আবু রায়হান তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা করার এক বছর পরও খুনিদের বিচার হয়নি।
তবে দুই মামলার বিচারকাজ থমকে থাকার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি আইয়ুব খান জানান, ‘জানুয়ারি মাসে মামলা দুটি ট্রাইব্যুনালে এসেছে। ওই সময় হরতাল-অবরোধ শুরু হওয়ায় সাক্ষীরা হাজির হতে পারেননি। আবার ধার্য দিনেও অনেক সাক্ষী আসেননি। এ ছাড়া গত ১৭ এপ্রিল থেকে বিচারকশূন্য রয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এসব কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ পিছিয়ে যাচ্ছে।’
আলোচিত এসব মামলার বিচার না হলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা উচিত। এসব মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। অপরাধীরা আইনের আওতায় না এলে নগরবাসীর আতঙ্ক কাটবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে এ ধরনের খুন বারবার হচ্ছে।’