‘গায়েবি হামলায়’ ভাঙা বাড়িতে ফিরছেন তাঁরা, নাম ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায়

‘গায়েবি হামলায়’ ভাঙা জাফর আহমদের বাড়ি। ছবিটি আড়াই বছর আগেরছবি: সংগৃহীত

টেকনাফ পৌরসভার পানির ফোয়ারা থেকে চার কিলোমিটার পশ্চিমে এগোলে বাহারছড়া লেঙ্গুর বিল এলাকায় রাস্তার পাশে সুরম্য একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। সামনে বাহারি গেট।  আড়াই বছর আগে এই বাড়ির ভেতর ও  বাইরের ফটক ভেঙে ফেলা হয়েছিল। বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মালিক জাফর আহমেদ। পুলিশের ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। তিনি এখন এই বাড়ি ভাড়া দিয়ে কাছের আরেকটি বাড়িতে বসবাস করেন।

গায়েবি হামলার পর মেরামত করা জাফর আহমেদের বাড়ি। এখন তিনি বাড়িটি ভাড়া দিয়েছেন
ছবি: প্রথম আলো

জাফর আহমেদের এই বাড়ি থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে উপজেলার সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়ায় সৈয়দ হোসেনের ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এখনো সীমানাপ্রাচীর ও ফটকের ভাঙা ইটের টুকরোগুলো পড়ে আছে। তাঁর বাড়িটিও ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এখন টিন দিয়ে নতুন করে সীমানাপ্রাচীর বানানো হয়েছে। পুলিশের ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় সৈয়দ হোসেনেরও নাম রয়েছে। ইয়াবা, অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের ১৮ মাস পর তিনি কারাগার থেকে জামিনে আসেন। এখন তিনি এই বাড়িতে বসবাস করেন।

দুটি বাড়ির ওপরই চালানো হয়েছিল ‘গায়েবি হামলা’। বাড়ির মালিকদের অভিযোগ, সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে চলতো এসব ‘গায়েবি হামলা’। জাফর আহমেদ ও সৈয়দ হোসেনের দাবি, তাঁরা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত নন।

‘গায়েবি হামলায়’ ভাঙার পর মেরামত করা বাড়িটিতে বসবাস করেন সৈয়দ হোসেন
ছবি: গাজী ফিরোজ

সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দুটি ডুপ্লেক্স বাড়িসহ টেকনাফে এ রকম ছোট–বড় প্রায় ৮০ টি বাড়িঘর ভাঙচুর হয়। এর মধ্যে একটি ছাড়া বাকি সবাই এখন বাড়িতে ফিরে এসেছেন। ৪৫টির মতো বাড়ি মেরামত হয়েছে। বাকি ৩৪ বাড়ির কিছু অংশের মেরামত কাজ হয়েছে। আর কিছু ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। সব বাড়ির মালিকের নাম পুলিশের ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে। পুলিশ সূত্র জানায়, কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে শুধু টেকনাফে রয়েছেন ৯১২ জন।

এসব বাড়ির বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘গায়েবি হামলা’ নামে ভয়ংকর হামলা চালিয়ে এসব বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। আর এই হামলা হয় সাবেক ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে। ওই সময় ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি।২০২০ সালের ৩১ জুলাই মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান খুনের মামলায় প্রদীপ কুমার দাশ গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে আসেন বাসিন্দারা। তাঁরা হামলা এবং পরিবারের নারী সদস্যদের নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করবেন জানিয়েছেন।

মাদক ব্যবসায়ী হলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িতে হামলা, পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন করা অপরাধ। গায়েবি হামলা কারা করেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।
সুজন টেকনাফ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন

স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর প্রদীপ ওসি হিসেবে যোগদানের পরদিন থেকে এ ধরনের হামলা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রদীপ ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন। এই ভিডিওতে তিনি বলেছেন, টেকনাফের প্রতিটি পাড়া-মহল্লার ইয়াবা কারবারিদের গ্রেপ্তার করা হবে । তাঁদের বাড়িতে গায়েবি হামলা হবে। কোনো কোনো বাড়ি ও গাড়িতে গায়েবি অগ্নিসংযোগও হতে পারে। এটির পর টেকনাফজুড়ে আতঙ্ক ছিল।

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভী পাড়ায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত জিয়াউর রহমানের বাড়ি। ‘গায়েবি হামলার’ পর বাড়িটি ওইভাবে আছে। তবে তাঁর স্বজনেরা বসবাস শুরু করেছেন
ছবি: গাজী ফিরোজ

বাহারছড়া লেঙ্গুর বিল এলাকায় জাফর আহমদের বাড়িটি ভাঙা হয় ২০১৯ সালের ২৭ জুন। জাফর আহমেদ টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি । তিনি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। পুলিশের ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। ভেঙে ফেলার ১৭ মাস পর বাড়িটির সংস্কার করা হয়। ওই সময় ফিরে আসেন জাফর ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তবে এখন তাঁরা ওই বাড়িতে থাকেন না। একটি বেসরকারি সংস্থাকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। পৌরসভার পল্লানপাড়ায় আরেকটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন জাফর। জাফর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অন্যায়ভাবে তার বাড়িটি ভাঙা হয়েছে। এ জন্য তিনি ওসি প্রদীপকে দায়ী করেন।

নাজির পাড়ায় সৈয়দ হোসেনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় তাঁর বাড়ির সামনে। তিনি সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য। পুলিশের ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। ইয়াবা ও অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের ১৮ মাস পর তিনি কারাগার থেকে জামিনে আসেন। সৈয়দ হোসেন দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। তালিকায় নাম আসায় ক্রসফায়ারের ভয়ে আত্মসমর্পণ করেন। উদ্ধার ইয়াবা ও অস্ত্র সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। ৫৫ বছর বয়সী সৈয়দ হোসেন দাবি করেন, দীর্ঘদিন প্রবাসে উপার্জিত টাকা দিয়ে বাড়িটি করেছেন। ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে ভেঙে দেওয়া বাড়িটির মেরামত কাজ প্রায়ই শেষ করেছেন। টুকটাক কাজ বাকি আছে। এখন তিনি মুরগির ফার্ম ও লবণের ব্যবসা করেন।

হামলা হওয়া বাড়িগুলোর বেশির ভাগ মালিকের নাম ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে। তাঁরা ফিরে আসায় ইয়াবা পাচার বেড়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যাতে নতুন করে কেউ জড়াতে না পারে।

পৌরসভার শাহ পরীর দ্বীপ সড়ক দিয়ে দুই কিলোমিটার এগোলে সদর ইউনিয়নের মৌলভি পাড়ায় রাস্তার পাশে আরেকটি সুরম্য ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখা গেছে। এটির গেট ও সীমানা দেয়াল ভাঙা। ভেতরে দরজা, জানালা, টাইলসগুলো ভাঙা পড়ে আছে। বেশির ভাগ কক্ষের দেয়াল নেই। দোতলার সামনের বারান্দার দেয়ালগুলোতে নতুন করে ইটের গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে। ভেতরে ঢুকে বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, বাড়িটির মালিক ওই এলাকার আবদুর রহমান। তিনি দুবাইতে থাকেন। পরিবার থাকে চট্টগ্রাম শহরে।

আবদুর রহমানের বাবা ফজল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে রাতের আঁধারে তাঁর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর হয়। এত দিন ভয়ে থাকলেও এখন তাঁরা মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

একই এলাকার বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া জিয়াউর রহমানের মা নুর বেগমের সঙ্গে কথা হয় তাঁর ভাঙা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে। বাড়িটির সামনে পেছনে ও ভেতরের দরজা, জানালা সব ভাঙা। গেট ও সীমানা দেয়ালেরও একই অবস্থা। শুধু বাড়ির মূল ফটকের দরজাটি মেরামত করে তাঁরা সেখানে বসবাস করছেন। আর সবকিছু আগেরই মতো।

প্রদীপ টেকনাফ থানায় যোগদানের দ্বিতীয় দিন ( ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর) গায়েবি হামলা চালিয়ে এসব করেন বলে অভিযোগ নুর বেগমের। তিনি অভিযোগ করে বলেন, শুধু বাড়িতে হামলা নয়, তিনি ও তাঁর দুই পুত্রবধূকে প্রদীপের সঙ্গে আসা লোকজন নির্যাতন করেছেন। তাঁরা হাসপাতালে সাত দিন চিকিৎসা নেন। পরে পুলিশের দেওয়া ইয়াবায় কারাগারে যান। তাঁরা কারাগারে থাকাকালীন ওই হামলার ২৬ দিনের মাথায় তাঁর ছেলে জিয়াকে গোপালগঞ্জ থেকে ধরে এনে বন্দুকযুদ্ধের নামে মেরে ফেলা হয়। তাঁর ছেলে লবণ ও গরুর ব্যবসা করতেন দাবি নুর বেগমের। তিনি বলেন, এখন বাড়িতে হামলা ও নির্যাতনের অভিযোগে প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।

এ ছাড়াও হ্নীলা লেদা এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল হুদা, তার ভাই নুরুল কবির, একই এলাকার মো. বাবুল, হোয়াইক্যংয়ের জুনায়েদ আলী চৌধুরী, পৌরসভার মো. জুবায়েরসহ ১৬ জন ব্যক্তি বলেছেন তাঁরা গায়েবি হামলার শিকার। তাঁরা মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, বাড়িতে হামলার ঘটনায় থানায় কেউ মামলা করেননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলা হলে তদন্ত করা হবে।

হামলা হওয়া বাড়িগুলোর বেশির ভাগ মালিকের নাম ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে। তাঁরা ফিরে আসায় ইয়াবা পাচার বেড়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যাতে নতুন করে কেউ জড়াতে না পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন টেকনাফ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন বলেন, মাদক ব্যবসায়ী হলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িতে হামলা, পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন করা অপরাধ। গায়েবি হামলা কারা করেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।