গ্রামবাসীর কথা বিশ্বাস করে ডাকাত ধরতে চেকপোস্টে যান, গুলি করেন সিনহাকে

সিনহা মো. রাশেদ খান
ছবি: সংগৃহীত

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী আজ রোববার আদালতে টানা পৌনে পাঁচ ঘণ্টা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে এই লিয়াকতের গুলিতেই নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। সিনহা হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি লিয়াকত আলী।

লিয়াকত আলী ওই সময় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ছিলেন। তিনি পুলিশের বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শকও। একটি সূত্র জানিয়েছে, জবানবন্দিতে লিয়াকত আলী বলার চেষ্টা করেছেন, মারিশবুনিয়া গ্রামের তিন ব্যক্তি তাঁকে ফোন করে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ওই ব্যক্তি (সিনহা) ডাকাত দলের সদস্য। তাঁর (সিনহার) হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। তিনি সহজে তিন গ্রামবাসীর কথা বিশ্বাস করে ‘ডাকাত’ ধরতে চেকপোস্টে অবস্থান নেন। তাঁর করা গুলিতে সিনহা নিহতের কথাও স্বীকার করেন লিয়াকত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও র‌্যাব-১৫–এর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তিন দফা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে পরিদর্শক লিয়াকত আলী সিনহা হত্যার ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তিনি সুস্থ মস্তিষ্কে আদালতে এসে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছেন। কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে পৌনে পাঁচ ঘণ্টার ধরে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন লিয়াকত আলী। কিন্তু সেখানে লিয়াকত আলী কী বলেছেন, তার কিছুই তিনি জানেন না।

আদালত সূত্র জানায়, আজ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে র‌্যাবের গাড়িতে করে লিয়াকত আলীকে কক্সবাজার আদালতে নেওয়া হয়। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার জন্য দুপুর ১২টার দিকে লিয়াকতকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে নেওয়া হয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে প্রিজন ভ্যানে তুলে তাঁকে (লিয়াকতকে) জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। জবানবন্দি গ্রহণের আগে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে লিয়াকতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।

৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা। এ সময় পুলিশ সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে আটক করে। পরে নীলিমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রা দেবনাথকে আটক করা হয়। দুজনই পরে জামিনে মুক্ত হন।

সূত্র জানায়, ৩১ জুলাই রাতে শামলাপুরের তল্লাশিচৌকিতে কী ঘটেছিল, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তার বিস্তারিত তুলে ধরেন লিয়াকত আলী। তিনি বলার চেষ্টা করেন, মারিশবুনিয়া গ্রামের তিন ব্যক্তি নুরুল আমিন, নাজিম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আইয়াস ঘটনার দিন তাঁকে (লিয়াকতকে) একাধিবার ফোন করে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ওই ব্যক্তি (সিনহা) ডাকাত দলের সদস্য। তাঁর (সিনহার) হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। যেহেতু পাহাড়টি ডাকাতপ্রবণ এলাকা, অনেকবার সেনাবাহিনীর পোশাকসহ ডাকাত ধরা পড়েছিল, তাই সহজে তিনি (লিয়াকত) ওঁদের (তিন গ্রামবাসীর) কথা বিশ্বাস করেন এবং ডাকাতদের ধরতে তিনি বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ি থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে তল্লাশিচৌকিতে অবস্থান নেন। নিজের গুলিতে সিনহা নিহত হওয়ার কথাও স্বীকার করেন লিয়াকত আলী। কিন্তু প্রাইভেট কার থেকে নামার সময় মেজর (অব.) সিনহার হাতে পিস্তল ছিল কি না অথবা সিনহা অস্ত্র তাক করেছিলেন কি না, এ ব্যাপারে লিয়াকত আলী কী বলেছেন; তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, ৩১ জুলাই রাতের ঘটনায় টেকনাফ থানায় করা পুলিশের মামলায় বলা হয়, সিনহা গাড়ি থেকে নেমে অস্ত্র তাক করলে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী গুলি করেন। এতে সিনহা মাটিতে লুটে পড়েন। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

লিয়াকত আলী
ফাইল ছবি

সিনহা হত্যা মামলার অগ্রগতি কতটুকু, জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ও র‌্যাবের এএসপি খাইরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, অনেক দূর। তাহলে কী কারণে সিনহাকে হত্যা করা হলো এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিরা এ ব্যাপারে কী বলেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে এএসপি খাইরুল ইসলাম বলেন, তদন্তের স্বার্থে কিছুই বলা যাবে না।

র‌্যাব সূত্র জানায়, সিনহা হত্যা মামলার মোট ১৩ জন আসামি রয়েছেন। তাঁরা হলেন টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, এসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ এবং টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আইয়াস।

রিমান্ড শেষে এপিবিএনের তিন সদস্য কয়েক দিন আগে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা তিনজন জেলা কারাগারে অবস্থান করছেন। ঘটনার সময় এপিবিএনের তিন সদস্য শামলাপুর তল্লাশিচৌকির দায়িত্বে ছিলেন।

সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে গত শুক্রবার তৃতীয় দফায় তিন দিনের রিমান্ডে নেয় মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। তাঁদের মধ্যে লিয়াকত আলী আজ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার অপর প্রধান দুই আসামি ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘তা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।’