ঘটনা ‘তাৎক্ষণিক’, অস্ত্র তাক করেননি সিনহা

  • ভিডিও বার্তায় শিপ্রা বলেছেন, আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে

  • ব্যক্তিজীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে

  • কারা ফটকে ওসি প্রদীপ ছাড়া দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ

  • জানতে চাওয়া হয় সিনহাকে গুলি করার কারণসহ নানা বিষয়

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশ সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ‘তাৎক্ষণিক’ এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে সিনহা পুলিশের দিকে কোনো অস্ত্র তাক করেননি বলেই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। র্যা বের দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

জানতে চাইলে র্যা বের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল সোমবার টেকনাফের মারিশবুনিয়ার ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা প্রতিটি তথ্য নিয়ে তদন্ত করছি। ইতিবাচকভাবে তদন্ত এগোচ্ছে। আপনারা সব জানতে পারবেন।’

র্যা বের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ ঘটনার প্রধান দুই অভিযুক্ত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এসব তথ্য পরিষ্কার হবে। সরকারের তদন্ত দলের সদস্যরা গতকাল কারাগারে গিয়ে লিয়াকত আলী ও নন্দদুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

এদিকে সিনহার ভিডিও দলের সদস্য শিপ্রা দেবনাথ গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় ন্যায় বিচারের আকুতি জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দিয়ে তাঁকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে নয়টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনার পর পুলিশ সিনহার নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে সিনহার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূরকে আটক করে। পরে নূরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর শিপ্রা জামিনে মুক্তি পান। তবে এ ঘটনা নিয়ে বাহিনীগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে এসে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। সিনহা নিহতের ঘটনায় প্রদীপ কুমার, লিয়াকত আলীসহ সাত পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা সবাই এখন কারাগারে।

এ ঘটনায় করা সব মামলা তদন্ত করছে র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব)। সংস্থাটির মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল মারিশবুনিয়ার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এর আগে তিনি সেনাবাহিনীর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বিশ্রামাগার ‘জলতরঙ্গে’ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

র্যা ব মহাপরিচালকের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, সিনহা হত্যা ঘটনাটি তাৎক্ষণিক, নাকি পরিকল্পিত বলে মনে করেন। জবাবে র্যা ব মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা এটা তদন্ত করছি, তদন্তের মাধ্যমে ফলাফল জানতে পারবেন। আমরা অনেক কিছু জেনেছি। তবে তদন্তের স্বার্থে সব বলতে পারছি না।’ সিনহার অস্ত্র সড়ক, না গাড়ি থেকে পাওয়া গেছে? জবাবে তিনি বলেন, এটা এখনই বলা যাবে না। আরও তদন্তের পর সবকিছু পরিষ্কার হবে। সিনহা পুলিশের দিকে অস্ত্র তাক করেছিলেন, তার কোনো প্রমাণ কি আপনারা পেয়েছেন, এ প্রশ্ন করা হলে র্যা ব মহাপরিচালক বলেন, এ মুহূর্তে তা বলা ঠিক হবে না।

র্যা বের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের দিকে সিনহার অস্ত্র তাক করার কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত তাঁরা পাননি। যদিও টেকনাফ মডেল থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতের দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছিল, সিনহা তাঁর কোমরের পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

কারাগারে তদন্ত কমিটি
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে চার সদস্য কারা ফটকে প্রদীপ কুমার দাশ ছাড়া দুই আসামি লিয়াকত আলী ও নন্দদুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

কারা সূত্র জানায়, বেলা সোয়া ১১টার দিকে তদন্ত কমিটির সদস্যরা তাঁদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সিনহাকে গুলি করার কারণ, গাড়ি থেকে সিনহার নামার মুহূর্ত কেমন ছিল এবং ঘটনার আগে-পরে তাঁর মুঠোফোনের কথোপকথনসহ নানা বিষয়ে জানতে চান তদন্তকারীরা।

শিপ্রার ভিডিও বার্তা
জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাত আছেন জলতরঙ্গ নামের একটি বিশ্রামাগারে। সেখান থেকেই এর আগে নিজের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য একটি ভিডিও দেন শিপ্রা। গতকাল সকালেও সেখান থেকে একটি ভিডিও বার্তা পাঠান সংবাদকর্মীদের কাছে। এতে শিপ্রা অভিযোগ করেন, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেন। শিপ্রা বলেন, সিনহার সঙ্গে পরিচয়ের এক বছর পর গত ৩ জুলাই থেকে একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ভিডিও তৈরির কাজ শুরু করেন তাঁরা। সিনহা ছিলেন সেই দলের অভিভাবক। সিনহা হত্যাকাণ্ডের পরের অবস্থা তুলে ধরে শিপ্রা বলেন, ৩১ জুলাই রাত ১২টার পর পুলিশ তাঁদের রিসোর্টে ঢুকে তল্লাশি শুরু করে। এ সময় সিনহা ও সিফাতের ব্যাপারে তারা কোনো কিছু জানায়নি। রাত আড়াইটার পর তাঁরা জানতে পারেন, সিনহা নিহত হয়েছেন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে পুলিশ

তাঁদের রামু থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে দুপুরে নেওয়া হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। শিপ্রা বলেন, ‘এ সময় আমি সিনহাকে শেষবারের মতো দেখার আকুতি জানাই। কিন্তু কেউ আমার কথায় কর্ণপাত করেনি। পরে আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়।’

কারাগারের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে শিপ্রা প্রশ্ন তোলেন, টেকনাফ উপজেলার সব পুরুষ মাদক ব্যবসায়ী হলেও তাঁদের ক্রসফায়ারে দেওয়া এবং তাঁদের স্ত্রীদের নির্যাতন করা কোন আইনে পড়ে? তিনি অভিযোগ করেন, অনেকের স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে মুক্তিপণের অর্থ নেওয়া হলেও তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় লাশ। তিনি মানবাধিকারকর্মীদের কারাগার পরিদর্শনের অনুরোধ করেন।

শিপ্রা বলেন, ‘সিনহাকে মেরে ফেলার পর তাঁকে ও তাঁর সহকর্মী সিফাতকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। তাঁর ব্যক্তিগত ছবি সম্পাদনা করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। সিনহা নিহত হওয়ার পর পুলিশ কটেজ থেকে সবকিছু নিয়ে যায়। এরপর ব্যক্তিগত ডিভাইস থেকে ছবি চুরি করে তা ফেসবুকে শেয়ার করা হচ্ছে। এসব দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে যারা অসহনীয় করে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। শিপ্রা বলেন, একজন মানুষ হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে তাঁর টুঁটি চেপে ধরে তাঁকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সেটা করা হলে লাখো তরুণ-তরুণী তার প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন না বলে জানান শিপ্রা।

শিপ্রার এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আটকের পর তাঁকে সব ধরনের সহায়তা ও সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তাঁকে কখনো হাজতেও রাখা হয়নি। এখন তিনি এসব কেন বলছেন, তার কিছুই তিনি জানেন না।

ব্যাংক হিসাব স্থগিত
এদিকে তদন্তের অংশ হিসেবে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপসহ আটজনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। এর ফলে এসব হিসাব থেকে আর অর্থ উত্তোলন করা যাবে না। পাশাপাশি তাঁদের হিসাবের লেনদেন বিবরণী চেয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

চিঠিতে যে আটজনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত ও তথ্য চাওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন এসপি এ বি এম মাসুদ হোসেন, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, চুমকী কারান, প্রতীম কুমার দাশ, প্রতুশ কুমার দাশ, মো. লিয়াকত আলী, দিলীপ এবং অভিনেতা ইলিয়াস কোবরা।