ঘুরেফিরে অপরাধে তাঁরা

আসামিদের আঙুলের ছাপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০ হাজার ব্যক্তি বারবার নানা ধরনের অপরাধ করার পর গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

২০১৫ সালের ২৩ জুলাই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে ছিনতাই করে পালানোর সময় এক ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরেন ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্য মোহাম্মদ পারভেজ। তাঁকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান এই দুর্বৃত্ত। আহত পারভেজ ওই দিনই হাসপাতালে মারা যান। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন আবু তাহের। চলতি বছরের মে মাসে জামিনে মুক্তি পান। এর তিন মাস না পেরোতেই ১৬ আগস্ট আরেকটি হত্যার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।

পুলিশ বলছে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে অপরাধে জড়ানো আবু তাহেরের মতো কিশোর বয়সেই অপরাধীর খাতায় নাম লেখান ঢাকার সবুজবাগের রুবেল চৌকিদার। বয়স ২৫ না পেরোতেই তাঁর ঘাড়ে এখন ১২ মামলা। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মাদক ও চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে করা এসব মামলায় একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি। জামিনে বেরিয়ে তিনিও অপরাধের পথে হেঁটেছেন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, আবু তাহের ও রুবেল চৌকিদারের মতো সারা দেশে এ রকম অপরাধীর সংখ্যা ১০ হাজারের মতো। পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটের ফরেনসিক বিভাগের তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত আসামিদের আঙুলের ছাপের (ফিঙ্গার প্রিন্ট) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঘুরেফিরে এঁরাই বারবার নানা ধরনের অপরাধ করার পর গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

পুলিশ জানায়, আবু তাহেরের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় মামলা আছে ১০টি। এর মধ্যে তিনটি হত্যা, একটি অস্ত্র, তিনটি মাদক ও তিনটি চুরির মামলা। তাঁর বিরুদ্ধে সর্বশেষ মামলাটি হয়েছে একজনকে হত্যার অভিযোগে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, মাদকের কারবার নিয়ে বিরোধের জেরে গত ১৬ আগস্ট আবু তাহের কক্সবাজার পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুর মোহাম্মদের ছেলে শাহজাহান সেজানকে খুন করেন। গত ২৪ আগস্ট ঢাকার সাভারে অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এর আগে গত ২৩ বছরে চারবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জামিনে বেরিয়ে আবারও জড়িয়েছেন অপরাধে।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার অপরাধে জড়ানো ১০ হাজার অপরাধীর মধ্যে ৭০ শতাংশই ঢাকা মহানগরের। বাকি তিন হাজার সারা দেশের। গ্রেপ্তার হয়ে কিছুদিন জেল খাটেন তাঁরা। জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধ করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় ৭০ শতাংশই মাদকের মামলা। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যও বলছে, সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে যত মামলা হয়, তার ৭০-৮০ শতাংশ মামলায় হয় মাদকসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে।

সিআইডির তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের তথ্যভান্ডারে ২ লাখ ৩০ হাজার আসামির আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত ছিল। সূত্রমতে, প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার নতুন আসামির আঙুলের ছাপ ডেটাবেইসে জমা হয়। তবে করোনাকালে এ সংখ্যা কিছুটা কমেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের মতো রাজধানীতেও মাদকের মামলা সবচেয়ে বেশি হয়। ডিএমপি এলাকার মোট মামলার প্রায় ৭০ শতাংশই মাদকের মামলা।

জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধে

পুলিশ জানায়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর রপ্তানির পোশাক চোর চক্রের মূল হোতা মো. সাঈদ ওরফে সিলেটি সাঈদকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ২৪টি চুরির মামলা আছে। একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আট মাস কারাগারে ছিলেন তিনি।

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের সুমনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে তিনটি ছিনতাইয়ের মামলা, ঢাকার সবুজবাগের ফরহাদের বিরুদ্ধে তিনটি মাদকের মামলা, কাফরুলের শাহজাহানের বিরুদ্ধে ছিনতাই ও মাদকের পাঁচটি এবং সাভারের হেমায়েতপুরের আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে মাদকের তিনটিসহ পাঁচ মামলা আছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রত্যেকেই আগে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিছুদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে তাঁরা আবার অপরাধে জড়ান।

আঙুলের ছাপে সহজে শনাক্ত

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ সূত্র বলছে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রথাগত পদ্ধতিতে (ম্যানুয়াল) আঙুলের ছাপের তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। পরে অটোমেটিক ফিঙ্গার আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে আসামিদের আঙুলের ছাপের সংরক্ষণ শুরু হয়। সিআইডির তথ্যানুযায়ী, প্রায় ১০ হাজার আসামির আঙুলের ছাপ তথ্যভান্ডারে থাকা ছাপের সঙ্গে একাধিকবার করে মিলেছে। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, এ মিলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁরা বারবার গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

সিআইডি জানায়, দেশের যেকোনো থানায় আসামি গ্রেপ্তার হলে তাঁর আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে পুলিশ। এ ছাড়া সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে। আর আসামির নাম–ঠিকানাসহ মামলার বিস্তারিত সংরক্ষণ করা হয় পুলিশের সিডিএমএস (ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) সফটওয়্যারে। এ ছাড়া অপরাধের শিকার ব্যক্তির শরীর ও ঘটনাস্থলের বিভিন্ন জিনিসপত্রেও অপরাধীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়। সেই ছাপও তথ্যভান্ডারের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে অপরাধী শনাক্ত করা হয়।

সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম মুস্তাফিজুর মুনির প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সূত্রবিহীন মামলাসহ নানা অপরাধের রহস্য উদ্‌ঘাটনে আঙুলের ছাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অপরাধী শনাক্তে কাজে লাগছে। সিআইডি ছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও অন্যান্য সংস্থাও মামলার তদন্ত ও আসামি গ্রেপ্তারে আঙুলের ছাপের তথ্যভান্ডারের সহায়তা নিচ্ছে।

‘সঠিক তদন্ত না হওয়ায় জামিন’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি তথ্যপ্রমাণ ঠিকভাবে হাজির করতে না পারেন, তাহলে তো জামিন হবেই। সঠিকভাবে তদন্ত না হলে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবে না। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে যদি মামলার তদন্ত হতো, তাহলে আসামিদের এভাবে জামিন হতো না।’ বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও একই ব্যক্তি বারবার অপরাধে জড়াচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।

প্রায় একই ধরনের মত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক শাহদীন মালিকের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপরাধে আসামির যে সংশ্লিষ্টতার কথা পুলিশ বলছে, এ ব্যাপারে তিন–ছয় মাস পার হলেও কোনো তথ্য হাজির করতে পারছে না। কত দিনে তারা এসব তথ্য দেবে, তত দিন কি আসামি জেলে থাকবে? এসব কারণেই জামিন হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে পুলিশকে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আদালতে তথ্যপ্রমাণ হাজির করে জামিন আটকাতে হবে।’