চিকিৎসা শেষে টাকা দিতে না পারায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুই রোগীকে আটকে রেখেছেন। এঁদের একজন মানিকগঞ্জের রাজবানু ২৬ দিন এবং আরেকজন রিকশাচালক আলাউদ্দিন দেড় মাস ধরে হাসপাতালে পড়ে আছেন।
হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সাংসদ এনামুর রহমান বলেছেন, হাসপাতালের পাওনা তাঁদের জোগাড় করতে হবে।
রাজবানু মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার পূর্ব বাস্তা গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমানের স্ত্রী। মতিয়ার পেশায় দিনমজুর। তিনি গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী গত ১৬ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়। ওই দিনই তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। নয় দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠে সে। তাকে ২৪ অক্টোবর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে না পারায় রোগীকে ছাড়াতে পারছি না।’
মতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ধার-দেনা করে ৩৭ হাজার ৬৯৮ টাকা হাসপাতালে দিয়েছেন তিনি। আইসিইউর ভাড়াসহ তারা আরও দুই লাখ টাকা দাবি করছে। এত টাকা তাঁর পক্ষে জোগাড় করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত আইসিইউর ভাড়া, ওষুধ, চিকিৎসকের ফি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা মিলিয়ে বিল দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮৩ টাকা।
রাজবানুকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধাক্কা দেয়। এতে তাঁর কান দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। দুর্ঘটনার পর তিনি জ্ঞান হারালেও হাসপাতালে আসার পথে রাস্তায় জ্ঞান ফিরে আসে তাঁর। সঙ্গে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথাও বলেন তিনি। এ অবস্থায় তাঁকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন বলে স্বজনেরা জানান।
স্থানীয় একজন সাংবাদিকের অনুরোধে মঙ্গলবার রাজবানুকে নিউরো সার্জারি বিভাগের নারী ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। নিউরো সার্জারি বিভাগের যে ওয়ার্ডে রাজবানুকে রাখা হয়েছে সেখানে তাঁর প্রহরায় আছেন দুজন নার্স। রাজবানুর মেয়ে সুফিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘নার্সরা কোনো কারণে ওয়ার্ড থেকে কোথাও গেলে মায়েরে তালা দিয়্যা যায়।’
গত শুক্রবার বিকেলে ওই ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় দুই নার্সের সঙ্গে। তাঁদের একজনের নাম ফারহানা। তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘রাজবানু এখন সুস্থ। বিল পরিশোধ করলেই তিনি বাড়ি চলে যেতে পারেন।’
একই রকম ‘বিন্দদশায়’ হাসপাতালটিতে দিন পার করছেন নড়াইল সদর উপজেলার আফরা গ্রামের রিকশাচালক আলাউদ্দিন। তাঁর প্রায় সাত লাখ টাকা বিল হয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিবারকে জানিয়েছে।
রিকশাচালক আলাউদ্দিনের মামা ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, বাসের ছাদ থেকে পড়ে আহত হলে আলাউদ্দিনকে প্রথমে যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কপাল বরাবর মাথা ফেটে যায় তাঁর। এরপর থেকে তিনি মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। এ অবস্থায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করা হয়। সেখানে এক দালাল তাঁদের প্ররোচিত করে এনাম মেডিকেলে নিয়ে আসে। এর সপ্তাহ খানেক পরে আলাউদ্দিন কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন দেখা যায়, তাঁর প্রায় দুই লাখ টাকা বিল হয়েছে। ওই টাকা দিতে না পারায় তাঁর রোগীকে ছাড়া হয়নি। তিনি বাড়ি গিয়ে জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে করতে প্রায় ১৫ দিন লেগে যায়। তিনি বলেন, ওই সময়সহ টানা ৪৬ দিন আইসিইউতে রাখা হয় আলাউদ্দিনকে। গত মঙ্গলবার তাঁকে নিউরো সার্জারি বিভাগের পুরুষ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। তিনি এর মধ্যে ১ লাখ ৮৯ হাজার ১১৪ টাকা পরিশোধ করেছেন।
ইদ্রিস আলী অভিযোগ করেন, শুধু বিল বাড়ানোর জন্যই এত দিন তাঁর ভাগনেকে আইসিইউতে রাখা হয়। আলাউদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই আমাকে বাঁচান, এখানে থাকলে আমি আরও অসুস্থ হয়ে যাব।’
এই দুই রোগীর অসহায়ত্বের কথা জানালে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান স্থানীয় সংসদ এনামুর রহমান শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি একটি বেসরকারি হাসপাতাল। বড়জোর শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বিল কমানো সম্ভব। বাকি টাকা তাদের জোগাড় করতে হবে।’
বিনা প্রয়োজনে আইসিইউতে রাখার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এনামুর রহমান বলেন, ‘এখন একটি জরুরি বোর্ড বসব। পরে এ বিষয়ে কথা বলি।’ কিন্তু এরপর তাঁর ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) শামিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ১০ শতাংশ শয্যা দরিদ্র রোগীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার বিধান আছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীকে কোনো প্রতিষ্ঠান বিনা চিকিৎসায় ফেরত দিতে পারবে না। কোনো দরিদ্র রোগী ব্যয় নির্বাহ করতে না পারলে ১০ শতাংশ শয্যার ব্যয় থেকে কর্তৃপক্ষ তা সমন্বয় করে নিতে পারে।