জাতীয় উদ্যানে বালুর অবৈধ ব্যবসা

কক্সবাজারের চকরিয়ায় সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানের ভেতরে চলছে বালুর অবৈধ ব্যবসা। ছবিটি ১২ অক্টোবর তোলা l প্রথম আলো
কক্সবাজারের চকরিয়ায় সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানের ভেতরে চলছে বালুর অবৈধ ব্যবসা। ছবিটি ১২ অক্টোবর তোলা l প্রথম আলো

কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশে চকরিয়ায় সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানের ভেতরে চলছে বালুর অবৈধ ব্যবসা। চলছে শতবর্ষী গর্জনগাছ নিধন। উদ্যানের ভেতরে তৈরি করা হচ্ছে ঘরবাড়ি-দোকানপাট। এতে অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়েছে এই উদ্যান।
অভিযোগ রয়েছে, বনকর্মীদের যোগসাজশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একদল নেতা-কর্মী করছেন বালুর রমরমা ব্যবসা।
বন বিভাগের তথ্যমতে, প্রায় ৯৭৮ একরের এই উদ্যানে শতবর্ষী গর্জনগাছ রয়েছে ১০ হাজার ৩৩৭টি। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বন বিভাগের সংরক্ষিত এই গর্জন বনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে।
১২ অক্টোবর সকালে চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়া এলাকার জাতীয় উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, বনের আশপাশের খাল ও ছড়া থেকে যন্ত্রের সাহায্যে বালু তুলে আনা হচ্ছে উদ্যানে। এরপর ট্রাকে বোঝাই করে এই বালু পাঠানো হচ্ছে কক্সবাজার, সাতকানিয়া, আমিরাবাদ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে। পাকা ভবনসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত হয় মোটা আকৃতির এই সাদা বালু। অভিযোগ আছে, এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে বনভূমি দখল করে তৈরি করা হয়েছে টিনের একটি ঘর। সেখানে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে—বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মেধাকচ্ছপিয়া শাখা কার্যালয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেছেন, মেধাকচ্ছপিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে স্থানীয় জামাল আহমদ সওদাগর, এনামুল হক বাদশা, মো. হোছন সওদাগর, আবদুল মান্নানসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অন্তত ২০ জন নেতা-কর্মী ও সমর্থকের একটি চক্র এই বালুর ব্যবসা করছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক এম রহমান মাসুদ বলেন, বালুর অবৈধ ব্যবসার কারণে ইতিমধ্যে উদ্যানের ভেতরে অর্ধশতাধিক শতবর্ষী গর্জনগাছ মরে গেছে। বালুর ব্যবসা বন্ধ না হলে এই গর্জন বনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
কচ্ছপিয়া ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জামাল আহমদ সওদাগর বলেন, তিনি এখন আর যুবদল করেন না, আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে বালুর ব্যবসা করছেন।
বালু ব্যবসায়ী জামাল সওদাগর বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন খাল-ছড়া থেকে আহরণ করা এক ডাম্পার (মিনি ট্রাক) বালু কিনি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। বিক্রি করি প্রতি ফুট বালু ২২ থেকে ২৫ টাকায়।’
বালু ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের কর্মী এনামুল হক বাদশা বলেন, কচ্ছপিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জাফর আলম বনের জমিতে দলীয় কার্যালয়টি তৈরি করেছিলেন। এখন সেটির দেখাশোনা করছেন বর্তমান সভাপতি জিল্লুর রহমান। কার্যালয়টি সারা দিন বন্ধ থাকে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাতে কার্যালয়টি খুলে বালুর ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করা হয়।
জিল্লুর রহমান বলেন, সংরক্ষিত এই বনের ভেতরে এক হাজারের মতো অবৈধ ঘরবাড়ি, দোকানপাট তৈরি হলেও বন বিভাগ নীরব। কিন্তু আওয়ামী লীগের কার্যালয় তৈরি নিয়ে যত হইচই। তাঁর দাবি, বালুর ব্যবসার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তিনি চট্টগ্রামে বসে বালুর ব্যবসা ও ঠিকাদারি করেন। তিনি আরও বলেন, এখানকার আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী গরিব। জীবিকার তাগিদে তাঁরা বালুর ব্যবসা করছেন।
বালুর ব্যবসার সঙ্গে বনকর্মীদের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে মেধাকচ্ছপিয়া বনবিট কর্মকর্তা আবু ছৈয়দ জাকারিয়া বলেন, বালুর ব্যবসার কারণে গর্জনগাছের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া বনের জমি দখল করে তৈরি করা হচ্ছে ঘরবাড়ি। বালু ব্যবসার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত। এ কারণে কিছুই করা যাচ্ছে না।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দলের নাম ভাঙিয়ে মেধাকচ্ছপিয়ার কতিপয় ব্যক্তির জাতীয় উদ্যানে বালুর ব্যবসার অভিযোগ পেয়েছি।’
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন, এই জাতীয় উদ্যানে অবৈধ বালুর ব্যবসার কারণে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
স্থানীয় ফুলছড়ি বন রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী মোকাম্মেল কবির বলেন, বনের ভেতরে বালুর ব্যবসা বন্ধ করতে গিয়ে বনকর্মীরা একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন। বালু জব্দ করতে গেলেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসেন। বিষয়টি সবারই জানা। এখন বালুর ব্যবসা বন্ধ করতে গেলে হয় গুলিতে মরতে হবে, নয়তো অন্যত্র চলে যেতে হবে।