মিরপুরের ৩ থানা
‘টাকা না দেওয়ায়’ আসামি
ভুক্তভোগী পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে তিনজনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
অভিযোগকারীরা হলেন ব্যবসায়ী, একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, মোটরসাইকেলের চালক ও যাত্রী।
চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় কারও কারও বিরুদ্ধে মানব পাচার ও মাদক মামলা হয়েছে।
গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা ঘটে।
পুলিশ তথ্যদাতা (সোর্স) ব্যবহার করে ফাঁদ পেতে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ।
চাহিদামতো চাঁদা না দেওয়ায় পুলিশের মিরপুর বিভাগের পৃথক তিন থানার ছয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে পাঁচ ব্যক্তিকে মাদক ও মানব পাচারের মামলায় জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। ওই পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে তিনজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও ভাড়ায় চলা মোটরসাইকেলের চালক ও যাত্রী।
গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা ঘটে। তবে এসব নিয়ে পাল্টা অভিযোগ এসেছে মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহতাবউদ্দিনের কাছ থেকে। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, মিরপুরে কয়েকটি চক্র সক্রিয়। তারাই পুলিশ সদস্যদের কাছে থেকে চাঁদা না পেয়ে অভিযোগ করেছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তথ্যদাতা (সোর্স) ব্যবহার করে ফাঁদ পেতে চাঁদা আদায় করছে। রাজধানীর রূপনগর টিনশেড এলাকার বাসিন্দা রাশিদা আক্তারের রিকশার ব্যবসা আছে। তাঁর সঙ্গে ঘটা একটি ঘটনা নিয়ে তিনি আইজিপি, ডিএমপির কমিশনার ও মিরপুর বিভাগের ডিসির কাছে আবেদন করেছিলেন। রাশিদা প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্যানসারে ভুগছেন। গত বছরের ১৯ আগস্ট রাতে রূপনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমান বাসায় ঢুকে চোরাই মুঠোফোন থাকার অভিযোগ তোলেন। তিনি এটি অস্বীকার করলে মাসুদুর পুরো বাসায় তল্লাশি চালিয়েও কিছু পাননি। একপর্যায়ে মাসুদুর তাঁর ব্যাগ থেকে জোর করে চাবি নিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলে সেখান থেকে আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যান। মাসুদুর তাঁর সোর্স সোহাগ ও অপুর যোগসাজশে এ টাকা লুট করেন।
রাশিদা আক্তার বলেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করলেও তিনি প্রতিকার পাননি। এতে ক্ষুব্ধ মাসুদুর তাঁকে একটি মানব পাচারের মামলায় ফাঁসিয়ে দেন।
এসআই মাসুদুরসহ রূপনগর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. জাহিদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মাদক মামলা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন রাসেল শিকদার। তিনি রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। গত ১ মার্চ মিরপুর বিভাগের ডিসির কাছে আবেদন করেন তিনি। এতে বলা হয়, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সময় মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের মিল্ক ভিটা সেলস সেন্টারের সামনে মাসুদুর ও জাহিদ মিলে রাসেলকে আটক করে সঙ্গে ইয়াবা আছে বলে শরীর তল্লাশি করেন। কোনো মাদক না পেলেও রাসেলকে হাতকড়া পরানো হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান রাসেলের বন্ধু হৃদয়। পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে রাসেলকে আটকের কারণ জানতে চাইলে হৃদয়কেও আটক করা হয়। হৃদয়কে ছেড়ে দিলেও থানায় নিয়ে রাসেলের বিরুদ্ধে গাঁজা রাখার অভিযোগে মামলা করে পুলিশ।
রাসেল শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকে এসআই মাসুদুর ও এএসআই জাহিদ এবং তাঁদের সোর্স আলামিন তাঁকে পুনরায় মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটানোর হুমকি দিচ্ছেন। মূলত সোর্স আলামিনের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে পুলিশ তাঁকে আটক করে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
রাশিদা ও রাসেলের অভিযোগের বিষয়ে এসআই মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কাউকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেননি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন।
নষ্ট মুঠোফোন মেরামতের কাজ করা হাবিব শেখ (২৭) নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাদকের মামলা হওয়া নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির কাছে লিখিত অভিযোগ করেন হাবিবের স্ত্রী সাথী আক্তার। হাবিব স্ত্রী–সন্তান নিয়ে মিরপুর–১১ নম্বরে থাকেন। লালমাটিয়ার শেখ কামাল স্কুলের সামনে ফুটপাতে তাঁর মুঠোফোন মেরামতের দোকান আছে।
সাথী আক্তারের লিখিত অভিযোগে পল্লবী থানার এসআই কাজী রায়হানুর রহমান ও এএসআই মাহবুবুর রহমানের নাম উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, সোর্সকে ব্যবহার করে ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে হাবিবকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সোর্স মিজানের মাধ্যমে সাথীর কাছে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করলে তা না দেওয়ায় হাবিবকে মাদক (হেরোইন) মামলায় ফাঁসানো হয়।
যোগাযোগ করা হলে পল্লবী থানার এসআই রায়হানুর রহমান বলেন, হাবিব শেখকে মাদকসহ ধরা হয়েছিল। তাঁকে নির্যাতন কিংবা তাঁর পরিবারের কাছে কোনো টাকা চাওয়া হয়নি।
মিরপুরের দারুস সালাম থানায় মোটরসাইকেলচালক রমজান শেখ ও যাত্রী আহমেদ নিলয়কে মাদক মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ আছে এএসআই আবদুল্লাহ আলম মামুনের বিরুদ্ধে।
মিরপুরে কয়েকটি চক্র সক্রিয়। তারাই পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা না পেয়ে অভিযোগ করেছে।আ স ম মাহতাবউদ্দিন, উপকমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগ
রমজান ও নিলয় বর্তমানে কারাগারে। রমজানের মামা মো. ইসরাফিল বলেন, গত ১০ মার্চ সকালে গাবতলীতে রমজান-নিলয়কে আটক করা হয়। টাকা না দিলে তাঁদের ইয়াবার মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। পরে রমজানের স্বজনেরা ২৫ ও নিলয়ের স্বজনেরা ৫০ হাজার টাকা এএসআই মামুনের হাতে তুলে দিলে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু দুজনের নামে ৫০টি করে ইয়াবা রাখার অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সেদিন দলের নেতৃত্বে ছিলেন এসআই জাবেদুল ইসলাম। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে ৫০টি করে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় জাবেদুল দারুস সালাম থানায় মামলা করেন। তাঁরা কোনো টাকা নেননি।