টাকা নিয়ে ভুয়া সনদ দেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার

মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোটায় চাকরির জন্য টাকার বিনিময়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ তৈরি করে দিয়েছেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সহিদুর রেজা। গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশের ১৯ সদস্যের ৭ জনের পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে জনপ্রতি ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখিয়ে চাকরি নেওয়ায় গত সোমবার পুলিশের ১৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পরপরই ওই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গা ঢাকা দিয়েছেন।

গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশের ১৯ সদস্যের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার ৭ জনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের সবাই টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন এবং সবাইকে সনদ সরবরাহ করেছেন সহিদুর রেজা। গ্রেপ্তার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ১৭ জন বেলকুচি উপজেলার, একজন শাহজাদপুরের এবং অন্যজন সিরাজগঞ্জ সদরের ঠিকানায় চাকরি নিয়েছেন।

বেলকুচি উপজেলার আদাচাকী গ্রামের মো. সবুজ মিয়া (টিআরসি-নম্বর ১৭১) পুলিশের চাকরি নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোটায়।
তাঁর বাবার নাম আনছার আলী। মা সবুরা খাতুন। গতকাল তাঁদের বাড়িতে গেলে সবুরা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলের চাকরির বিষয়ে বেলকুচির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সহিদুর রেজাকে জমি বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা দিয়েছি।’ তাঁর স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে চাকরি হয়েছে এটা জানি।’

একই গ্রামের কামরুল ইসলামের (টিআরসি নম্বর ২৭১) মা রেহানা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কামরুলের চাকরির জন্য ৮ ডিসিমাল জমি বিক্রি করে কমান্ডারকে (সহিদুর রেজা) ৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। কোন কোটায় চাকরি হয়েছে তা জানি না।’

দক্ষিণ বানিয়াগাতী গ্রামের রজব আলীর স্ত্রী ও পুলিশ সদস্য মো. আল আমিনের (টিআরসি নম্বর ৪৮৩) মা শাহানা বেগম বললেন, ‘তিন দফায় সহিদুর কমান্ডারকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। সনদ তৈরি করার কথা বলে টাকা নিয়েছে। কয়েকটি কাগজও আমাদের কাছে দিয়েছে। পরে টাকা নেওয়ার সময় কাগজগুলো নিয়ে যায়। চাকরি কীভাবে দিয়েছে তা আমরা জানি না।’

একই উপজেলার কাজীপুরা গ্রামের মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘নিজে ব্যবসা-বাণিজ্য করি। মুক্তিযুদ্ধ করি নাই। ছেলে মো. আবু হানিফের চাকরির জন্য কমান্ডারকে টাকা দিয়েছি, এটা সত্য। কাগজপত্র কমান্ডারই তৈরি করেছেন।’

দেলুয়াকান্দি গ্রামের পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত উপপরিদর্শক মো. ছানা উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরি থেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। কিন্তু সনদপত্র নেওয়া হয়নি। ছেলে আব্দুল কুদ্দসের চাকরির জন্য সবকিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছে কমান্ডার সহিদুর।’

বয়রাবাড়ী গ্রামের সোনা উল্লাহ মণ্ডলের দুই সন্তানের চাকরি হয়েছে পুলিশে। সোনা উল্লাহ বললেন, ‘১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছি। কিন্তু সনদপত্র সংগ্রহ করি নাই। সনদপত্র সংগ্রহসহ সার্বিক দায়িত্ব কমান্ডারকে দিয়েছিলাম। সে-ই সবকিছু করেছে।’ কত টাকা দিতে হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে মনে নেই।’

উপজেলার কোনাবাড়ী গ্রামের আব্দুল বারীর সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর সেনাবাহিনীতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর ঢাকায় চাকরি করি। সনদপত্র নেওয়া হয়নি। আমার ছেলে ফেরদৌসের চাকরির বিষয়ে সহিদুর ভাইকে কিছু টাকা দিয়েছিলাম এটা সত্য।’

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক আগে থেকেই টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দিয়ে আসছেন ওই কমান্ডার। কাজীপুরা গ্রামের আবু আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমরা চাকরি পাই না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরি হচ্ছে।’

বেলকুচি উপজেলা ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গাজী নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া সবার বাবার সনদপত্রই ভুয়া। সাবেক কমান্ডার সহিদুর রেজা দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করার সময় টাকার বিনিময়ে অনেক সনদপত্র দিয়েছেন। পুলিশে চাকরিও দিয়েছেন। আমাদের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ আসার পর আমরা তা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়কে জানাই। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে সহিদুরকে কেন্দ্রীয়ভাবে বরখাস্ত করা হয়।’ তিনি জানান, পুলিশ সদস্যরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সহিদুর রেজা গা ঢাকা দিয়েছেন।

কমান্ডার সহিদুর রেজার সঙ্গে কথা বলার জন্য একাধিকবার তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বাসায় গেলে সেখানে তাঁর স্ত্রী পরিচয় দিয়ে মিনা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘তিনি অসুস্থ। চিকিৎসকের কাছে গেছেন। কখন আসবেন জানি না।’

শাহজাদপুর উপজেলার ডেপুটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বিনয় কুমার পাল বলেন, ‘শাহজাদপুরের আগুনকালী গ্রামের শুকুর আলীর গেজেটে কোনো নাম নেই। তিনি একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ছেলে মো. সাইফুল ইসলামের চাকরি হওয়ার পর থানায় তদন্ত এলে আমরা তার বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ভুয়া সনদের বিষয়ে জিডি করা হয়েছে।’

মামলার এজাহার ও সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশ সদস্যরা ২০১২ সালে কনস্টেবল পদে নিয়োগ পান। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি হওয়ায় ওই সব সনদ যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়। যাচাইয়ের সময় সনদগুলো ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপারকে মামলা করার নির্দেশ দেয়। মামলার বাদী সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইনের তৎকালীন রিজার্ভ কর্মকর্তা (আরও) বর্তমানে আটঘরিয়া থানার উপপরিদর্শক মো. নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সনদপত্রগুলো ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মামলা করা হয়। তবে মামলা তদন্তের ভার দেওয়া হয় দুদককে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পাবনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, পূর্ণাঙ্গ তথ্যের জন্য আসামিদের রিমান্ডে আনতে হতে পারে।

সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি অনেক আগের। শুনেছি, ওই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (সহিদুর রেজা) মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উল্লেখ করে প্রত্যেকের নামে একটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় থেকে সনদপত্র ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে।’