ডিএনএ টেস্টে ৪ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে

ওপরে সাইফুর ও তারেক। নিচে অর্জুন ও শাহ মাহবুবুর
ছবি: সংগৃহীত

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তরুণীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের সঙ্গে চারজনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে ডিএনএ টেস্টে। অন্যরা ধর্ষণে সহায়তা করেছেন। আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিলে আসামিদের ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা ছিল। প্রায় দুই মাসের মাথায় ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন পুলিশের হাতে যায়। পুলিশ এখন মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিলের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে।

যে চারজনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে, তাঁরা হলেন সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম ওরফে তারেক, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি ও অর্জুন লস্কর।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার বি এম আশরাফ উল্যাহ আসামিদের ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন পুলিশের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গতকাল রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আদালতে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া ছিল মামলার তদন্তের মূল অগ্রগতি। অভিযোগপত্র দাখিলে ডিএনএ টেস্টের অপেক্ষা ছিল। সম্প্রতি ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন হাতে এসেছে। এখন যে কাজটি চলছে, সেটি হচ্ছে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের প্রস্তুতি।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী (২১)। করোনার কারণে বন্ধ থাকা ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। ওই রাতেই ধর্ষণের শিকার তরুণীর স্বামী বাদী হয়ে মহানগরের শাহপরান থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার পর দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ধর্ষণবিরোধী আইনও সংশোধন করে সরকার।

মামলা দায়েরের পর সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে এজাহারভুক্ত আসামি সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম ওরফে তারেক, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুম এবং সন্দেহভাজন আসামি মিসবাউর রহমান ওরফে রাজন ও আইনুদ্দিন নামের আরও দুই যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কোনো পদে না থাকলেও গ্রেপ্তার হওয়া সবাই এমসি কলেজ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারের পর আটজন আসামিকে পর্যায়ক্রমে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তাঁরা। জবানবন্দিতে প্রধান আসামি সাইফুর, তারেক, শাহ মাহবুবুর ও অর্জুন লস্কর ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। রবিউল ও মাহফুজুর ধর্ষণে সহায়তা করার কথা স্বীকার করেন। সন্দেহভাজন দুই আসামিও আদালতে জবানবন্দি দেন। এর আগে ছয় আসামির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে টেস্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।

ধর্ষণের রাতে এমসি কলেজে ছাত্রাবাসে প্রধান আসামি সাইফুর রহমানের দখলে থাকা কক্ষে অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সাইফুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে।

কবে নাগাদ অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হতে পারে, তা জানতে চাইলে শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকেও তদন্ত তদারকি করা হচ্ছে। এখানে সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। তদন্তের সব কাজ শেষ। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

এদিকে ধর্ষণের পর পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল ভুক্তভোগী তরুণীকে। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে তিন দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান তিনি। শারীরিক ক্ষত সারলেও তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি বলে জানিয়েছেন ওই তরুণীর স্বামী।

করোনা পরিস্থিতির সময় বন্ধ কলেজ ছাত্রাবাসে এ রকম ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কলেজ কর্তৃপক্ষ ২৬ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত তিন সদস্যের এই কমিটি ১০ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেয়।

২৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) মো. শাহেদুল খবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ১ অক্টোবর এই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।৩০ সেপ্টেম্বর সিলেট আঞ্চলিক কেন্দ্রের পরিচালক মো. গোলাম রাব্বানীকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাঁচ কার্যদিবস পর এই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। চারটি তদন্ত কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিলেও এখন পর্যন্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি।

তবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা না হলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১২ অক্টোবর ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের ছাত্রত্ব বাতিল করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া চার শিক্ষার্থী হলেন সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান।

তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করা প্রসঙ্গে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ বলেন, ‘পুলিশ এই ঘটনায় তদন্ত করছে। বিচার বিভাগের নির্দেশেও আলাদা আরেকটি তদন্ত হয়েছে। আমাদের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এগুলো প্রভাব ফেলতে পারে। তাই তদন্ত প্রতিবেদনটি আপাতত সিলগালা করে রাখা হয়েছে। পুলিশ মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করার পর তা প্রকাশ করা হবে।’