ডিবির তদন্তে বেরিয়ে এল, ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়েছিল র‌্যাব

দীপক ভৌমিক তৈরি পোশাকের ব্যবসা করেন। তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে সাদাপোশাকের লোকজন। যাওয়ার সময় বলে গেছে, তারা ডিবির লোক। কিন্তু ডিবির তদন্তে জানা গেছে, সাদাপোশাকের ওরা ছিল আসলে ‘কালো পোশাকের জন্য’ পরিচিত র‌্যাব সদস্য। পোশাকের এই মারপ্যাঁচে পড়া দীপক ল্যান্ডমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান।

রাজধানীর মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের বাসা থেকে গত ২৪ আগস্ট বিকেলে দীপক ভৌমিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সাদাপোশাকে আসা অস্ত্রধারী ৮-১০ জন নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছে বলে জানান দীপকের ছেলে রাকেশ পিয়ারী ভৌমিক। পরদিন বিকেলে অবশ্য ছাড়া পেয়ে দীপক বাসায় ফিরে আসেন।

এর আগেই বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কাফরুল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রাকেশ পিয়ারী ভৌমিক। জিডিতে বলা হয়, অস্ত্রধারীরা বাবাকে বলেছেন, ‘আপনার নামে অভিযোগ আছে। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।’ তারা বাবা, মায়ের ব্যবহৃত তিনটি আইফোনও নিয়ে যায়। সাদা রঙের কালো গ্লাসযুক্ত একটি মাইক্রোবাসে (ঢাকা মেট্রো চ ৫৩-৭২৩০) করে তাঁকে নেওয়া হয়। যাওয়ার সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য একটি মোবাইল নম্বরও দিয়ে যায়।

রাকেশ পিয়ারী ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, জিডির পর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দার এবং একজন যুগ্ম কমিশনার এসে তাঁদের ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজও নিয়ে গেছেন তাঁরা।

রাকেশের করা জিডির তদন্ত করেন কাফরুল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে, ‘যিনি জিডিটি করেছিলেন, তিনি পরের দিন ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর বাবাকে পাওয়া গেছে। ফোনে তাঁর সঙ্গে আমাকে কথাও বলিয়ে দেন। উনারা এ বিষয়ে আর কিছু বলেননি। পাওয়া গেছে—এই তথ্য জিডিতে নোট দিয়ে রেখে দিয়েছি।’

‘যেহেতু এটা আমার আওতাধীন এলাকা, তাই আসলেই ডিবি এমনটি করেছে কি না, তা আমাকে খতিয়ে দেখতে বলা হয়। তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি তাঁকে ডিবি তুলে নেয়নি।
মানস কুমার পোদ্দার, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু এটা আমার আওতাধীন এলাকা, তাই আসলেই ডিবি এমনটি করেছে কি না, তা আমাকে খতিয়ে দেখতে বলা হয়। তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি তাঁকে ডিবি তুলে নেয়নি।’ তাহলে কারা নিয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে পারব না।’

তবে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, দীপক ভৌমিককে র‌্যাব-৪-এর কয়েকজন সদস্য তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁরা তদন্তে নিশ্চিত হয়েছেন। বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরকে প্রতিবেদন দিয়ে জানানো হয়েছে।

দীপক ভৌমিককে র‌্যাব-৪-এর কয়েকজন সদস্য তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁরা তদন্তে নিশ্চিত হয়েছেন। বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরকে প্রতিবেদন দিয়ে জানানো হয়েছে।
মো. মাহবুব আলম, গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার

পুলিশ সদর দপ্তরের স্মারক সূত্রে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রতিটি ইউনিটকে ৯ ডিসেম্বর একটি চিঠি দেয় ডিএমপি। তার শিরোনাম ছিল, ‘র‌্যাব-৪-এর ৮-১০ সদস্য কর্তৃক ডিএমপির ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ল্যান্ডমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যানকে বাসা থেকে নিয়া যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে’। চিঠিতে বলা হয়, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যগণ বা সন্ত্রাসী কর্তৃক কাউকে তুলে নিয়ে গেলে ডিবির পরিচয় ব্যবহার করা হয়। এতে জনমনে ডিবি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ও আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। সাদাপোশাকে অভিযান পরিচালনাকালে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে সংশ্লিষ্ট ইউনিট বা বিভাগের মনোগ্রামসংবলিত জ্যাকেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে চিঠিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

চিঠিতে ২০১৩ সালের ১২ জানুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরের জারি করা সার্কুলারের নির্দেশানুযায়ী, ‘সিভিল বিষয়ে পাবলিক পিটিশনের ওপর তদন্ত’ বা ‘পুলিশিং এখতিয়ার বহির্ভূত’ কাজ থেকে বিরত থাকতে ইউনিটগুলোকে বলা হয়েছে।

তবে দীপক ভৌমিককে কেন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তাঁর ছেলে রাকেশ। একই প্রশ্ন করা হয়েছিল ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তারকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেন ওই ব্যক্তিকে তুলে নিয়েছিল, সেটা তাঁদের তদন্তের বিষয় ছিল না। তাঁদের তদন্তের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ডিবির নাম ব্যবহার না করে অভিযানে নিজ নিজ ইউনিটের নাম ব্যবহার নিশ্চিত করা।

র‌্যাব-৪-এর সদস্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখতে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ, র‌্যাবের মুখপাত্র

এই ঘটনা সম্পর্কে র‌্যাব সদর দপ্তর অবগত আছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, র‌্যাব-৪-এর সদস্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখতে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।