তদন্তে আরসার বিষয়টিও বিবেচনায় নেবে পুলিশ

অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মুহিবুল্লাহর ভাইয়ের মামলা। খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে একজন গ্রেপ্তার।

মুহিবুল্লাহ

রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনায় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠেছে, তদন্তে তা বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে খুনের ঘটনায় করা মামলায় আরসার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের মামলার আসামি করা হয়েছে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এদিকে খুনে জড়িত সন্দেহে সেলিম উল্লাহ (৩০) নামের এক রোহিঙ্গাকে গতকাল শুক্রবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনায় আরসার সংশ্লিষ্টতা এবং তিনজনকে শনাক্ত করার কথা গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন তাঁর ভাই হাবিবুল্লাহ। অবশ্য রাতে উখিয়া থানায় তিনি বাদী হয়ে যে মামলা করেছেন, তাতে আরসার বিষয়টি উল্লেখ করেননি। মামলায় এটি উল্লেখ না করার কারণ কী, তা জানতে গতকাল দিনভর চেষ্টা করেও হাবিবুল্লাহর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

তবে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (এপিবিএন) মো. আজাদ মিয়া গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বাদী মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনায় আরসার জড়িত থাকাসহ যেসব অভিযোগ করেছেন, তা আমলে নিয়েই তদন্ত চলছে।

উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের পাশের কুতুপালং ক্যাম্প-৬ থেকে গতকাল সকালে সেলিম উল্লাহকে গ্রেপ্তার করেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা। পরে তাঁকে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ বলছে, সেলিম একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কি না, তা জানাতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে মুহিবুল্লাহ হত্যার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে তাঁর বিবৃতিটি প্রচার করা হয়েছে।

এ ছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশলেতে গতকাল এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, শুধু হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের বিচার নয়, মুহিবুল্লার হত্যার পেছনে কি উদ্দেশ্য ছিল তা খুঁজতে একটি দ্রুত, পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্ত চালানো উচিত।

উখিয়া এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর পরিস্থিতি এখনো থমথমে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন ও পুরোনা মিলিয়ে ৩৪ রোহিঙ্গা শিবিরের সব কটিতেই নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গত বুধবার রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন মুহিবুল্লাহ। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করে গতকাল বিভিন্ন শিবিরে জুমার নামাজের পর মোনাজাত করেছেন রোহিঙ্গারা।

উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাইমুল হক বলেন, লম্বাশিয়া শিবিরে মুহিবুল্লাহর বাড়িতে পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

মুহিবুল্লাহ খুনে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। তারা আল ইয়াকিন নামেও পরিচিত) তিন সদস্য আবদুর রহিম, মোরশেদ ও লালু—এই তিনজনকে শনাক্ত করার কথা গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন মামলার বাদী হাবিবুল্লাহ। ওই তিনজন আরসার সদস্য এবং লম্বাশিয়া শিবিরেই অবস্থান করেন বলে একাধিক রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) গতকালও সাংবাদিকদের বলেছেন।

মুহিবুল্লাহ খুনের পর অন্য মাঝিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাঁরাও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া মুহিবুল্লাহর সংগঠনের সদস্যরাও এখন অনেকটা আত্মগোপনে রয়েছেন।

লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবির এলাকা উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের আওতাধীন। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়শিবিরের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের জঙ্গিগোষ্ঠী আরসাসহ একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা থাকার কথা তাঁরা বিভিন্ন সময়ে শুনেছেন। এ ছাড়া প্রায় সময়ই শিবিরে সংঘাত-গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, হতাহতও হয়। রোহিঙ্গা শিবিরের অস্থিরতা নিয়ে স্থানীয় মানুষ উদ্বিগ্ন।

প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকলেই খুন?

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিজেদের আদি নিবাসে ফেরত যেতে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য কাজ করাই মুহিবুল্লাহ খুনের অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করেন বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা মাঝিরা। তাঁরা বলছেন, এর আগেও যাঁরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁদের ওপর হামলা হয়েছে। দুজন খুনও হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৮ সালের জুন মাসে বালুখালী শিবিরে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় আরিফ উল্লাহ নামের এক রোহিঙ্গা মাঝিকে। তিনি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করতেন।

এ ছাড়া ২০১৯ সালের মার্চে টেকনাফের ল্যাদা ক্যাম্পে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় আরেক রোহিঙ্গা নেতা আবদুল মোতালেবকে। তিনি ওই ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতেন।

সন্দেহের তির হাকিম বাহিনীর দিকেও

মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনায় আবদুল হাকিম বাহিনীও জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হাকিমের বাড়ি ছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে। এই বাহিনীর সঙ্গেও আরসার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে রোহিঙ্গা মাঝিরা বলছেন। রোহিঙ্গা শিবিরে অপহরণ ও ডাকাতির বিভিন্ন ঘটনায় এই বাহিনীর নাম এসেছে। ২০১৬ সালের ১৩ মে টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরের পাশে শালবন আনসার ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় হাকিম বাহিনী জড়িত। এ সময় আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। নিয়ে যায় ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র।

টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক আবদুল হালিম বলেন, হাকিম ডাকাতের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অস্ত্র, ডাকাতিসহ ২৭টি মামলা। হাকিমকে ধরতে চেষ্টা চলছে।

জনপ্রিয় নেতা মুহিবুল্লাহ

বিভিন্ন শিবিরের রোহিঙ্গারা মুহিবুল্লাহকে সম্মান করে ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ বলে ডাকতেন। উখিয়া শিবিরে গতকাল আবদুল কাদের (৬০) নামের এক রোহিঙ্গা প্রথম আলোকে বলেন, মুহিবুল্লাহর মতো বিচক্ষণ নেতা রোহিঙ্গারা আর পাবে না। তিনি সবার প্রিয় নেতা ছিলেন। ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর চেষ্টার শেষ ছিল না।

আরেক রোহিঙ্গা কামাল আহমদ (৫৫) বলেন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের টার্গেট ছিলেন মুহিবুল্লাহ। এখন কী কারণে তাঁকে হত্যা করা হলো, তা দেখার বিষয়।

টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেড মাঝি বদরুল ইসলাম ও হোয়াইক্যং উনছিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ রফিক বলেন, মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা সম্মানের সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।