তবু থেমে নেই মাদক ব্যবসা

করোনার পাঁচ মাসে উদ্ধার হওয়া মাদক গত বছরের এই সময়ে উদ্ধার হওয়া মাদকের অর্ধেকের বেশি।

প্যাকেটের গায়ে লেখা ছিল ‘নট ফর সেল’। একটি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা সাবানের ওই প্যাকেটে পাওয়া যায় ১৫ হাজার ইয়াবা বড়ি। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে গত ১ জুন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আসা একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে র‌্যাব। সেটার পেছনের দরজার ঝালাই ভেঙে জব্দ করা হয় ওই মাদক।

করোনা মহামারির মধ্যেও বন্ধ হয়নি মাদক পরিবহন ও বেচাকেনা। পণ্যবাহী গাড়ি, পিকআপ, ট্রাক, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ, উত্তর ও পূর্বাঞ্চল দিয়ে নানাভাবে ঢাকায় আসছে মাদকের চালান।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সময় মাদকের চালান আটক করা হয়েছে। কিন্তু সব চালানের তথ্য জানা যায় না।

গত ৮ মার্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হন। এরপর ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দেশজুড়ে করোনা প্রতিরোধে লকডাউন চলে। এ সময় পণ্যবাহী ও জরুরি সেবায় যুক্ত পরিবহন ছাড়া অন্য সব গণপরিবহন বন্ধ ছিল। ট্রাক, কুরিয়ার সার্ভিস ও নিত্যপণ্যের গাড়িতে মাদকের ছোট-বড় চালান আটক করে পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত পাঁচ মাসে (মার্চ থেকে জুলাই) রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ইয়াবা বড়ি ও ২২ হাজার বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে। বরাবরের মতো উদ্ধার হওয়া মাদকের মধ্যে এবারও শীর্ষে ছিল ইয়াবা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, এই পাঁচ মাসে উদ্ধার হওয়া মাদক গত বছরের এই সময়ে উদ্ধার হওয়া মাদকের অর্ধেকের বেশি।

মার্চ থেকে জুলাইয়ে উদ্ধার হওয়া অন্য মাদকের মধ্যে ছিল ২১ হাজার ৭৭৪ বোতল ফেনসিডিল, ১ হাজার ৬০৬ কেজি গাঁজা, সাড়ে ২৭ কেজি হেরোইন। এর সঙ্গে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ৫ হাজার ২১৫ জনকে। এসব ঘটনায় রাজধানীর ৫০ থানায় মামলা হয় ৩ হাজার ২৯৩টি।

গত বছরের তুলনায় মাদক উদ্ধার কম কেন, জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত মার্চ থেকে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। ওই সময় শুধু পণ্যবাহী পরিবহন চলেছে। যেসব পরিবহন মাদক বহন করছে, পুলিশ গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সেসব পরিবহন থেকে মাদক উদ্ধার করেছে। তিনি বলেন, করোনার সময় মাদক উদ্ধারে পুলিশের মনোযোগ ছিল না। লকডাউন এলাকায় দায়িত্ব পালন পুলিশের অগ্রাধিকারে ছিল এবং তারা ওই কাজে ব্যস্ত ছিল। তাঁর কথা, মাদক উদ্ধারে মূল দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। পুলিশ সুযোগ পেলে মাদক উদ্ধারে অভিযান চালায়।

পুলিশ কমিশনারের কথার সূত্র ধরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনার সময় লকডাউন চলাকালে এই প্রতিষ্ঠানের মাদক উদ্ধারে অভিযান বন্ধ ছিল। তবে অধিদপ্তরের বিভিন্ন দল ২৫ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ১০ দিনের বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩৮১ জনকে গ্রেপ্তার করে। জব্দ করা হয় ২ হাজার ৫টি ইয়াবা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অভিযান) এ এফ এম মাসুম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময়ে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে মাদকের বেচাকেনা কম ছিল। তবে অনলাইনে কিছু হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাদক উদ্ধারে অভিযানও কম হয়েছে। তবে গত আগস্ট থেকে বেড়েছে অভিযান, উদ্ধার ও মামলার সংখ্যা।

মাদক পাচারে নানা কৌশল

অভিযানের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া হয়ে ঢাকায় ঢুকছে। একইভাবে ভারত থেকে আসা ফেনসিডিল ও গাঁজা চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে রাজধানীতে। এ ছাড়া হেরোইনসহ নানা ধরনের মাদকও আসছে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে অভিযানের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, নানা কৌশলে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় মাদক নিয়ে আসছেন কারবারিরা। কারবারিদের লোকেরা পৃথক গাড়িতে করে তাঁদের পাহারা দিয়ে কক্সবাজার জেলা পার করিয়ে দেন। নিরাপত্তাচৌকি দেখলে মুঠোফোনে সতর্ক করে দেন অগ্রগামী পাহারাদারেরা।

গত ২৮ মে বিকেলে র‌্যাব-২-এর একটি দল ঢাকার আশুলিয়ায় কুরিয়ার সার্ভিসের একটি গাড়িতে শিশুখাদ্যের মধ্যে থাকা দেড় কেজির বেশি হেরোইন জব্দ করে। পিকআপে থাকা দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের একজন নারী।

গত ২১ মে রাতে রাজধানীর আদাবর রিং রোডের মোড়ে নিরাপত্তাচৌকিতে র‌্যাব-২ কাঁঠাল ও ডাবভর্তি পিকআপ আটক করে। পিকআপটিতে ‘জরুরি প্রাণীখাদ্য উৎপাদন কাজে নিয়োজিত’ স্টিকার সাঁটা ছিল। চালক, চালকের সহকারী ও দুই যাত্রীর প্রত্যেকের কাছে সাত হাজার করে ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়। যাত্রী দুজনের পিঠের ব্যাগে একটি করে বন্দুক ও ছয়টি গুলি ছিল।

গত ২৬ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি ট্রাক আটক করে ৪০ হাজার ইয়াবা বড়িসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।

অভিযান পরিচালনাকারী ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম সাকলায়েন বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া মাদক ব্যবসায়ীরা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, কক্সবাজারের নাপিতখালীর মাদক ব্যবসায়ী মোশারফের কাছ থেকে তাঁরা ইয়াবা কিনে ঢাকার মাদক ব্যবসায়ী রিপনের কাছে বিক্রির জন্য আনেন।

২০১৮ সালের ৪ মে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। অভিযানের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলেন, শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি ‘ক্রসফায়ারের’ পর মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা কমে গিয়েছিল।

করোনাকালেও মাদক ব্যবসা চলমান থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, করোনায় লকডাউনের সময় মানুষকে সুরক্ষা ও তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে পুলিশ বেশি ব্যস্ত ছিল। তাই এ সময় নিরাপত্তাচৌকি বসিয়ে সেভাবে পরিবহনে তল্লাশি চালানো হয়নি। পুলিশের কাজে কিছুটা শৈথিল্য ছিল। মাদক ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। আর যেহেতু মাদক লাভজনক ব্যবসা, সে কারণে ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে তাঁদের অপতৎপরতা চালিয়ে গেছেন।

ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের বক্তব্য সমর্থন করে শহীদুল হক বলেন, মাদকদ্রব্য উদ্ধার বা মাদকের অভিযান করা পুলিশের কাজ নয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকেই মাদক উদ্ধারে প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে।