তাঁদের ‘অপরাধী মন’ পায়নি দুদক

এফ আর (ফারুক রূপায়ন) টাওয়ারে আগুন জ্বলছে।
ফাইল ছবি।

বনানীর এফ আর টাওয়ারের নকশা জালিয়াতির মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগপত্র থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাত কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অন্য আসামি ও সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের প্রশ্ন, জাল নকশা অনুমোদনকারী দোষী না হলে প্রস্তাবকারী কীভাবে দায়ী হয়?

এই মামলায় দুদকের চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে রাজউকের তৎ​কালীন চেয়ারম্যান কে এ এম হারুনসহ সাতজন অব্যাহতি পেয়েছেন, যাঁরা দুদকের প্রথম অভিযোগপত্রে আসামি ছিলেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক গত বছরের ২৫ নভেম্বর আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন।

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ২৩ তলা এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন মারা যান, আহত হন ৭৩ জন। এরপরই এফ আর টাওয়ার নির্মাণে নকশা জালিয়াতির তথ্য জানাজানি হয়। এ ঘটনায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলাদা তদন্ত করে। দুর্নীতি দমন কমিশনও অনুসন্ধান শেষে মামলা করে।

মামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে দেখা যায়, সাতজনের প্রত্যেককে ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কারও ক্ষেত্রে অবৈধ কাজের সহযোগিতার ‘অপরাধী মন’ পাওয়া যায়নি, কেউ ‘সরল বিশ্বাসে’ ফাইলে অনুমতি দিয়েছেন, এমন কথাও বলা হয়েছে। আবার কেউ অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় দাপ্তরিক কাজ করেননি বলা হয়েছে। অবশ্য রাজউকের সাবেক অথরাইজড অফিসার সৈয়দ নাজমুল হুদা মৃত্যুর কারণে অব্যাহতি পেয়েছেন।

দুদকের এই মামলায় অন্যতম আসামি রাজউকের তৎ​কালীন চেয়ারম্যান কে এ এম হারুনকে অব্যাহতি দিয়ে বলা হয়েছে নকশা জালিয়াতির ঘটনায় তাঁর ‘অপরাধী মন’ পায়নি দুদক। তাঁর বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, কে এ এম হারুন রাজউকের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান হিসেবে এফ আর টাওয়ারের ১১ তলার সিঁড়ি ১০ নম্বর অফিস স্পেস বিক্রির প্রস্তাব অনুমোদন করলেও পরবর্তীকালে তিনি জাল নকশার ভিত্তিতে ১৯ থেকে ২৩ তলা নির্মাণের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ কাজের সহযোগিতা করার ‘মেনস রিয়া (অপরাধী মন)’ পাওয়া যায়নি।

আরেক অব্যাহতিপ্রাপ্ত আসামি আ ই ম গোলাম কিবরিয়া (সাবেক সদস্য, এস্টেট) সম্পর্কে বলা হয়, এই ভবন নির্মাণের ডেভিয়েশনের ক্ষেত্রে তাঁর কোনো দায়দায়িত্ব ছিল না। আরেক সাবেক সদস্য (এস্টেট) রেজাউল করিম তরফদার অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘সরল বিশ্বাসে’ ভবনের ২০, ২১ ও ২২ তলা বন্ধক দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তবে তিনি অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্রম যথাযথভাবে তদারকি করেননি বলে উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু অবসরে চলে যাওয়ায় সেই সুযোগ নেই।

অব্যাহতি পাওয়া সাবেক অথরাইজড অফিসার সামছুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ নির্মাণকাজের সহযোগিতার প্রমাণ পায়নি দুদক। সাবেক প্রধান ইমারত পরিদর্শক মাহবুব হোসেন সরকার এফ আর টাওয়ারের ছাড়পত্র প্রদান, নকশা অনুমোদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। যদিও রাজউকের তদন্তে তাঁকে দায়ী করা হয়। এ ব্যাপারে দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়, মনিটরিংয়ের অভাব ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য বিভাগীয় তদন্তে তাঁকে দায়ী করা হয়েছে।

আর সাবেক ইমারত পরিদর্শক আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী (নান্নু) এফ আর টাওয়ার নির্মাণের সময় সিবিএ সভাপতি ছিলেন। সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি দাপ্তরিক কাজ করতে পারেননি। যদিও ওই সময়ে আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী রাজউক ভোগ্যপণ্য সমবায় সমিতি নামের একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সে সময় তিনি দাপ্তরিক অনেক ফাইলে সইও করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই অভিযোগপত্রে কেউ অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, কেউ কেউ অব্যাহতি পেয়েছেন। সব তথ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি ভিন্ন কিছু বলেন, তা সঠিক নয়।

অভিযুক্তদের দুজন বলছেন, অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, নকশা জাল করে ১৯ থেকে ২৩ তলা নির্মাণের বিষয়ে চেয়ারম্যান আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তাঁদের দাবি, নকশা জালিয়াতির বিষয়টি প্রথম নজরে আসে এস্টেট বিভাগের। তারাই এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে নোট প্রস্তাব পাঠায়। এখন জালিয়াতির জন্য এস্টেট শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়ী হলে প্রস্তাব অনুমোদনকারী চেয়ারম্যান ও সদস্য (এস্টেট) কেন অভিযুক্ত হবেন না।

অভিযুক্ত ১৮ জন আসামির একজন রাজউকের সাবেক সহকারী পরিচালক (এস্টেট) শাহ মো. সদরুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের সম্পত্তি শাখা ভূমি বরাদ্দ দেয়। নকশা জালিয়াতি করে অতিরিক্ত পাঁচতলা নির্মাণের জন্য সম্পত্তি শাখা দায়ী নয়। নকশা অনুমোদনসহ ভবন নির্মাণ এবং এর তদারকির দায়িত্ব নকশা অনুমোদন শাখার। অথচ এই শাখার তিনজনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।