বারবার বলেছিলাম, ডাকাত নই, তবু কথা শোনেনি

ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া আল আমিন
ছবি: সংগৃহীত

১০ বছর আগে সাভারের আমিনবাজারে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের হাতে ৬ বন্ধুর মৃত্যু হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন আল আমিন। দুর্বৃত্তদের লাঠির আঘাত ও ধারালো অস্ত্রের কোপে গুরুতর আহত আল আমিন এখনো ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। যাঁদের জন্য তাঁর জীবনের এই করুণ পরিণতি, তাঁদের সাজা হওয়ায় তিনি খুশি। আল আমিন এই মামলার তারকা সাক্ষী।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আল আমিন আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন আমরা বারবার বলেছিলাম, ডাকাত নই। আমরা ছাত্র। আমরা আইডি কার্ডও দেখিয়েছিলাম। তবু তাঁরা আমাদের কথা শোনেননি। আমার মাথায় বাড়ি দিলে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। আমার ছয় বন্ধু আর বড় ভাইকে তাঁরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। আজ ১৩ জনের ফাঁসি হয়েছে, ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। আমি অনেক খুশি।’

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) শাকিলা জিয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আল আমিন। এই মামলায় তিনি আমাদের তারকা সাক্ষী। তাঁর সাক্ষ্য মামলা প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’

২০১১ সালের ১৭ জুলাই পবিত্র শবেবরাতের রাতে সাত বন্ধু ঘুরতে গিয়েছিলেন ঢাকার অদূরে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে। দিবাগত রাত সোয়া একটার দিকে স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্ত সাত ছাত্রকে ডাকাত বলে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করেন। এতে ছয় ছাত্র মারা যান। প্রাণে বাঁচেন আল আমিন। ১০ বছর আগের ওই হত্যা মামলার আজ বৃহস্পতিবার রায় হয়েছে। ঢাকা জেলার দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ ইসমত জাহান ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৫ জনকে খালাস দেন। আর তিন আসামির বিচার চলাকালে মৃত্যু হয়।

সেদিনের ঘটনায় শামস রহিম, তৌহিদুর রহমান, ইব্রাহিম খলিল, কামরুজ্জামান, টিপু সুলতান ও সিতাব জাবির নিহত হন।

তারকা সাক্ষী আল আমিন

আমিনবাজারে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় ৬০ আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণে রাষ্ট্র পক্ষে ৫৫ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁদের মধ্যে একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আল আমিন। এ ছাড়া এই মামলায় ১৪ জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেন।

আল আমিনের বাবা হবি ব্যাপারী আদালতে
ছবি: আসাদুজ্জামান

বাদীপক্ষে আইনি সহায়তা দেওয়া আইনজীবী ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মামলায় ১৪ জন আসামির স্বীকারোক্তি আর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আল আমিনের সাক্ষ্য অভিযোগ প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে তারকা সাক্ষী আল আমিনের সাক্ষ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

আল আমিন রাষ্ট্রপক্ষের ৪৩তম সাক্ষী। আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে আল আমিন বলেছিলেন, ‘সেদিন ছিল শবেবরাতের রাত। ওই রাতে আমি, আমার বন্ধু পলাশ, কান্ত, ইব্রাহিম, সুলতানসহ সাতজন দারুসসালাম এলাকার ফুরফুরা শরিফ মসজিদে এশার নামাজ পড়ে যে যার বাসায় চলে যায়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার ফুরফুরা জামে মসজিদে এসে শবেবরাতের নামাজ আদায় করি। পরে আমি ও আমার বন্ধুরা সেহরি খাওয়ার জন্য গাবতলীতে যাই। তখন বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছিল, সেহরি পরে খাই। চলো সবাই মিলে আমিনবাজারের ব্রিজের দিকে ঘুরে আসি। আমিনবাজারের ব্রিজের ওপরে যাওয়ার পর বৃষ্টি আসে, তখন আমরা ব্রিজের নিচে ছাপরা ঘরে আশ্রয় নিই। বৃষ্টি কমলে আমরা তিন বন্ধু আমি, কান্ত ও পলাশ নদীর ওপরে লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে বসে মোবাইল ফোনে গান শুনছিলাম। তখন হাউকাউ শুনি। তখন ছাপরা ঘরে থাকা অন্য বন্ধুদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। তবে সেখানে যাওয়ার আগে ১০–১৫ জন লোক আমাদের কাছে চলে আসেন। তাঁরা আমাদের চোখে টর্চ ধরে বলেন, “আমরা কোথায় থাকি।” তখন বলি, “আমরা থাকি দারুসসালাম এলাকায়। সেখান থেকে ঘুরতে এসেছি।” কিন্তু তখন লোকগুলো বলেন, “আমরা ডাকাত।” তখন আমরা বলি, “ডাকাত নই।” কিন্তু লোকগুলো আমার কথা শোনেননি। আমাদের ডাকাত বলে একজন লোহার পাইপ দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। যখন আমার জ্ঞান ফেরে, তখন আমার সঙ্গে থাকা বন্ধুদের কাউকে দেখিনি।’

আল আমিন আদালতে আরও বলেন, ‘জ্ঞান ফেরার পরও আমাকে লোকজন এলোপাতাড়ি লাঠি ও কিল–ঘুষি মারতে থাকে। বাঁচার জন্য পিস্তল হাতে থাকা একজনের পা ধরি এবং বলি “আঙ্কেল আমাকে বাঁচান।” তখন লোকটি আমাকে বলেন, “তোকে বাঁচাব। তবে যা বলতে বলব, তা–ই তোকে বলতে হবে।” তখন আমি তাকে বলি, “আপনি আমাকে বাঁচান। আপনি যা বলবেন, আমি তা–ই করব।” তখন লোকটি অন্য লোকজনকে আমাকে মারতে নিষেধ করেন। একজনকে ডেকে আমার হাতে হ্যান্ডকাফ পরাতে বলেন। তখন আমি বুঝতে পারি, ওই লোক ছিলেন পুলিশ।’

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আল আমিন বলেন, ‘পরে পুলিশ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। যাওয়ার পথেও লোকজন আমাকে এলোপাতাড়ি মারধর করে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আমি পুলিশকে জিজ্ঞেস করি, আমার সঙ্গে আসা বন্ধুরা কোথায়? তখন পুলিশ আমাকে বলে, ছয়জন মারা গেছে। পরে মোবাইল ফোনে বাবা-মাকে ঘটনা জানাই। তখন তাঁরা হাসপাতালে আসেন। পরে পুলিশ আমাকে সাভার থানায় নিয়ে যায়। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়।’

নিহত ছাত্রদের স্বজনেরা আদালতে
ছবি: আসাদুজ্জামান

মামলার প্রধান আসামি মালেক যা বলেন

মামলার প্রধান আসামি আবদুল মালেককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মালেক ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।
মালেক আদালতে বলেন, ‘রাজিব, মনির, সেলিম, ফরিদ, শাহীন, নিহর, রাশেদ, বশির, রানা, আলমগীর, রুবেল, মজিবর, রজ্জব, আলম, নুর ইসলাম, মোবারক, আসলাম, মাসুদ, সাঈদ, জুয়েল, টুটুল, সাত্তার, বাদশা, তোতন এবং সাইফুলসহ আরও অনেকে ছয় থেকে সাতজনকে ডাকাত সন্দেহে পেটান। রামদা, চাকু, ছোরা ও লাঠি দিয়ে মারধর করতে করতে কেবলার চরের দিকে নিয়ে যান। আমি আর হামিদ তাঁদের সঙ্গে যাই। একজন আহত অবস্থায় থাকেন। তাঁর নাম আল আমিন। এরপর মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা দেয়। তখন বড়দেশী গ্রাম থেকে অনেক লোক বালুর মাঠে আসেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে। ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ আমাদের থানায় ডেকে নেয়। তখন সাভার থানার ওসি আমাকে ডাকাতি মামলার বাদী করে।’

আর কারও বুক যেন খালি না হয়

আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যায় ১৩ জনের ফাঁসি আর ১৯ জনের যাবজ্জীবন রায়ে সন্তুোষ প্রকাশ করেছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। রায় ঘোষণার পর ইব্রাহিম খলিলের বাবা আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বুকের মানিককে বিনা অপরাধে ওরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। আমাদের ছয় ছয়টা সন্তানকে খুন করেছে। যাদের জন্য আমরা সন্তান হারিয়েছি, তাদের এই আদালতে সাজা হয়েছে। আমরা খুশি।’

রায় শুনতে আদালতে এসেছিলেন বেঁচে যাওয়া আল আমিনের বাবা হবি ব্যাপারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সন্তান আজ পঙ্গু। কাজ করতে পারে না। এদের সাজা হওয়ায় আমি খুশি।’