তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রিয়জনের হাতে খুন

তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরে পরিবারের মধ্যেই একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। চলতি মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত পাঁচটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কখনো ছেলের হাত মা, কখনো মায়ের হাতে ছেলে, আবার কখনো ভাইয়ের হাতেই ভাইকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
পুলিশ বলছে, তুচ্ছ ঘটনায় পরিবারের মধ্যেই ঘটা এসব খুন রোধ করা সম্ভব নয়। সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, নৈতিক অবক্ষয় ও মানসিক বিষণ্নতা দূর করা না গেলে এ ধরনের খুনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে। পুলিশ ও নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরের চান্দগাঁও মোহরা এলাকায় ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় বৃদ্ধ রওশন আক্তারকে ছুরিকাঘাতে খুন করে পালিয়ে যান তাঁর ছেলে জহিরুল হক। আগের দিন রাতে পাহাড়তলীর দক্ষিণ কাট্টলীর লবণপাড়ায় চাচাতো ভাই চন্দন বিশ্বাসকে রডের আঘাতে খুন করেন বিশু দেবনাথ। পাহাড়তলী থানার ওসি রণজিত কুমার বড়ুয়া বলেন, গভীর রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করতে নিষেধ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে চন্দনকে রডের আঘাতে খুন করেন বিশু দেবনাথ।
এ ঘটনার ঠিক দুদিন আগে ১১ অক্টোবর লাভ লেন এলাকার একটি বাসায় কলেজে যেতে বলায় বড় ভাই স্থপতি সোহেল চৌধুরীকে (৪২) ঘরের মধ্যেই ছুরিকাঘাতে খুন করেন কলেজপড়ুয়া ছোট ভাই রায়হান চৌধুরী। পরদিন রাতে অনুশোচনাদগ্ধ রায়হান নিজেই পুলিশের হাতে ধরা দেন। গত বুধবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শাসন করায় বড় ভাইকে খুন করার কথা স্বীকার করেন রায়হান।
বায়েজীদ বোস্তামী থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ৮ অক্টোবর টেক্সটাইল এলাকায় তেলের দোকানমালিক আবদুল কাদেরকে দোকানের ভেতর খালাতো ভাই আলমগীর খুন করে পালিয়ে যান। তেল মাটিতে ফেলে দেওয়ায় বকাঝকা করায় ভাইকে খুন করেন বলে আটকের পর আলমগীর পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। এদিকে সতীনের ছেলেকে খুন করতে নিজের ছেলেসহ চার কিশোরকে ব্যবহারের অভিযোগে বেবি আক্তার নামের এক নারীকে ৯ অক্টোবর গ্রেপ্তার করেছে বন্দর থানা-পুলিশ। পরদিন খুনের পরিকল্পনা করার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন ওই নারীসহ পাঁচ কিশোর। নগর পুলিশ কমিশনার মো. আবদুল জলিল মন্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনায় ঘরের ভেতর আপনজনের হাতে আপনজনের খুনের ঘটনা পুলিশের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব না।’
সমাজবিজ্ঞানীরাও বলছেন, পারিবারিক বন্ধন না থাকার কারণে মা ছেলেকে, ছেলে মাকে খুন করছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী ইন্দ্রজিৎ কুন্ডু বলেন, যুবকদের সামনে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কোনো আদর্শ নেই। এগুলো সংস্কারে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগী হতে হবে। আদর্শহীন পরিবারে অর্থবিত্ত ও রংচঙে আবহে আবেগতাড়িত হয়ে বড় হচ্ছে তারা। এ ছাড়া পারিবারিক বন্ধনের অনভূতি না থাকা আর নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে তুচ্ছ ঘটনায় প্রিয়জনকে খুন করতে দ্বিধা করছে না। তাই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে।
বিকৃত মানসিকতা, মানসিক বিষণ্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে প্রিয়জনের হাতে প্রিয়জন খুনের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ সাজ্জাদ কবীর। তিনি বলেন, স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়ালগুলোর প্রভাব পরিবার ও ব্যক্তিজীবনেও পড়ছে। নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কেউ কারও সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করছে না। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে একে অপরকে খুন করতেও তাই দ্বিধা করছে না তারা।