দুই বেয়াই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা!

মো. মোসলেহ উদ্দিন ও বজলে কাদির। সম্পর্কে তাঁরা বেয়াই। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও দুজনেরই সরকারি গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম রয়েছে। তবে তাঁদের নিজেদেরও ধারণা নেই কীভাবে তাঁদের নাম মন্ত্রণালয়ের গেজেটে এসেছে। কেননা, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য কখনো কোথাও আবেদন করেননি।

এই দুজনের মধ্যে মো. মোসলেহ উদ্দিন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সহকারী পরিচালক শাহ আলমের বাবা। আর বজলে কাদির শাহ আলমের শ্বশুর। জামুকার কর্মকর্তাদের দাবি, ক্ষমতার অপব্যবহার করে শাহ আলম নিজের এই দুই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছেন।

তালিকায় নাম ওঠা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গতকাল মঙ্গলবার এ দুজনকে
ডেকে শুনানি করে। বজলে কাদির শুনানিতে লিখিতভাবে জানান, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা নই। মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে আমার নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আমি কখনো আবেদন করিনি। আমার নাম গেজেটে কীভাবে আসল আমার জানা নেই। গেজেটটি বাতিল করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’ শুনানিতে একই কথা বলেন মোসলেহ উদ্দিনও। তিনি বলেন, ‘আমি পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোথাও সম্মুখযুদ্ধ করি নাই। ছোট ছোট বোম দিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। কিন্তু বোমের নাম মনে নাই।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর শাহ আলমের বাবা স্থানীয় ব্যবসায়ী মোসলেহ উদ্দিন এবং একই বছরের ২ ডিসেম্বর শ্বশুর স্কুলশিক্ষক বজলে কাদিরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে তালিকার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কুমিল্লার হোমনা থানার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় বজলে কাদিরের এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় মোসলেহ উদ্দিনের নাম ওঠে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামুকার কর্মকর্তা শাহ আলমের শ্বশুর ও বাবা দুজনেরই শুনানিতে প্রমাণ হয়েছে তাঁরা কেউই মুক্তিযোদ্ধা নন। শাহ আলমই তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যে অপরাধ করেছেন, এ কারণে তাঁকে বরখাস্ত করা হবে। আর তাঁর বাবা ও শ্বশুরের সনদ বাতিলের পাশাপাশি তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে। আমরা দু-এক দিনের মধ্যে শাহ আলমকে ডাকব।’

জামুকা সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলে শাহ আলম সরকারি চাকরিতে আবেদনের সময় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করার কথা, যা তিনি করেননি।

জানতে চাইলে জামুকার সহকারী পরিচালক শাহ আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার শ্বশুরের বিষয়ে আমি জানি না। তিনি কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, তিনি জানেন।’ তবে শাহ আলম দাবি করেন, তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বাবা শুনানিতে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি জানালে শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে কী বলেছে আমি জানি না। তবে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’

এদিকে বাঞ্ছারামপুর ও হোমনা থানার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম আলোকে বলেন, মোসলেহ উদ্দিন ও বজলে কাদিরের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম ওঠার বিষয়টি তাঁদের জানা নেই। হঠাৎ করে ২০১৩ সালে তাঁরা জানতে পারেন, তাঁদের দুজনের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বাঞ্ছারামপুরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এইচ এম আবদুল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, শাহ আলমের বাবা বা শ্বশুর কেউই মুক্তিযুদ্ধে যাননি। এটা এলাকার সবাই জানে। তাঁদের গেজেটের বিষয়টি জানাজানির পর থেকে লোকে এ নিয়ে সমালোচনা করে। এরপর থেকে তাঁরা ভাতাও নিতে আসেন না। সুযোগ-সুবিধাও নেন না।

হোমনা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বজলে কাদির বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উজানচর উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। যখন জানতে পারলাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় বজলে কাদিরের নাম উঠেছে, তখন তাঁকে ডেকে এনেছিলাম। তিনি বলেছেন তাঁর মেয়ের জামাই ঢাকায় জামুকাতে বড় পদে চাকরি করেন, তিনিই এ গেজেট করেছেন। তবে তিনি আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। তাঁর এলাকার একাধিক মুক্তিযোদ্ধা আমাকে জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ের জামাই জামুকায় চাকরি করেন। তিনিই তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছেন।’

এসব বিষয়ে বজলে কাদির বলেন, ‘ওই গেজেট ব্যবহার করে আমি বা আমার কোনো পোষ্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিনি। আমার গেজেটটি বাতিল করা হোক। ’