দুবাইয়ের যৌনপল্লি থেকে তরুণী উদ্ধার, আসামিদের অব্যাহতি চায় পুলিশ

যৌন নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

ঘটনা চার বছর আগের। বাংলাদেশি এক তরুণীকে দুবাইয়ে পাচার করা হয়। পরে তাঁকেসহ বাংলাদেশের আরও তিন তরুণীকে দুবাইয়ের একটি যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করে সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস। এ ঘটনায় মামলা হয়। তদন্ত শেষে আসামিদের অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় রাজধানীর পল্টন থানা-পুলিশ।

অবশ্য নথিপত্র পর্যালোচনা করে আদালত এক আদেশে বলেন, দুবাইয়ে চার তরুণী যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। পুলিশ দুবাইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেনি। এমনকি যে হাসপাতালে তরুণীরা চিকিৎসা নেন, সেখান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেনি তারা।

কোনো তথ্য সংগ্রহ না করে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন বলে উল্লেখ করেন আদালত। একে অসদাচরণের শামিল বলে আখ্যা দেওয়া হয় আদালতের ওই আদেশে।

পরে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন আদালত। তদন্ত করে পিবিআই জানিয়েছে, ওই তরুণীকে দুবাইয়ে পাচার ও যৌনপল্লিতে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করার ঘটনায় সাক্ষ্য-প্রমাণ পেয়েছে তারা।

ওই ঘটনায় এসএম ওভারসিজ নামের একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক মহসিন আলী এবং তাঁর সহযোগী মাঈন উদ্দিনকে আসামি করে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই। তাঁদের মধ্যে মহসিন জামিনে আছেন। পলাতক রয়েছেন মাঈন উদ্দিন। মহসিনের পক্ষ থেকে আদালতে দাবি করা হয়েছে, তিনি নির্দোষ।

যা আছে মামলার এজাহারে

মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়েকে দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিলেন মহসিন আলী। ঢাকার পুরানা পল্টনে তাঁর প্রতিষ্ঠান এসএম ওভারসিজের অফিস। ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তাঁর মেয়েকে দুবাইয়ে পাঠানো হয়।

দুবাইয়ে পৌঁছানোর পরদিন ওই তরুণীকে একটি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মহসিনের সহযোগী মাঈন উদ্দিন তাঁকে দুবাইয়ের একটি অপরাধী চক্রের কাছে বিক্রি করে দেন। এরপর সেখানে মেয়েটির ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়। খবর পেয়ে দুবাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁর বাবা।

পরে ওই তরুণীসহ চারজনকে উদ্ধার করে ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

মামলায় বলা হয়, দেশে ফেরার পর চার তরুণীকে রাজধানীর একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই তরুণীর ফরেনসিক পরীক্ষা হয়। এরপর তিনি ঢাকার একটি আদালতের বিচারকের কাছে দুবাইয়ে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দেন।

আদালতে জমা দেওয়া দুবাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ফকির মুহাম্মদ মনোয়ার হাসান স্বাক্ষরিতে এক চিঠি থেকে জানা যায়, এক নারীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুবাইয়ের যৌনপল্লি থেকে চারজনকে উদ্ধার করা হয়। ভুক্তভোগীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআইর পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশি ওই তরুণীকে পাচার করা হয়েছিল। পরে তাঁকে আন্না নামের ভারতীয় এক নাগরিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরে ওই তরুণী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন।

ঘটনায় জড়িত ভারতীয় নাগরিকসহ অন্যদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাঁদের বিস্তারিত পরিচয় জানার পর আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে বলে জানান পিবিআই কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান।

পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, মহসিন আলী ও মাঈন উদ্দিন আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য। তাঁরা বাংলাদেশের নারীদের দুবাইয়ে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সেখানে নিয়ে যান। পরে দুবাইয়ের বিভিন্ন যৌনপল্লিতে তাঁদের বিক্রি করে দেন। ভ্রমণ ভিসায় ভুক্তভোগী তরুণীকে দুবাই পাঠানো হয়েছিল। তরুণীর পরিবারের কাছ থেকে তাঁরা দুই লাখ টাকা নিয়েছিলেন। আবার তাঁকে বিক্রি করে ভারতীয় নারীর কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নেন।

‘এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই’

পিবিআইর তদন্তে ঘটনার সত্যতার বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেও মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলমগীর কবির ২০১৯ সালে ৩১ মার্চ মামলার দুই আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসআই আলমগীর কবির উল্লেখ করেন, বাদী ও আসামিপক্ষের ‘আপসনামা’ পর্যালোচনা করেছেন তিনি। সেখানে দেখতে পান, ভুক্তভোগী তরুণী পছন্দের কাজ না পাওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মামলা হয়েছিল।

জানতে চাইলে এসআই আলমগীর গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, বাদী ও আসামিপক্ষ আপস করেছিল। ওই আপসনামার ওপর ভিত্তি করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তিনি।

আসামিদের সঙ্গে আপস হয়েছিল কি না, জানতে ভুক্তভোগী তরুণীর বাবার মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে এ বিষয়ে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা চারজন তরুণীকে উদ্ধার করলেন, সেই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এই অপরাধের ক্ষেত্রে আপস করার সুযোগ নেই।