দেশের কারাগারগুলোতে বড় কর্তাদের প্রশ্রয়ে দুর্নীতি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশের কারাগারগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্রয়-প্রশ্রয়’। সরকারের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলা হয়েছে, কারা অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শকেরা (ডিআইজি) গতানুগতিকভাবে কারাগার পরিদর্শন করেন। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়গুলো তাঁরা কখনোই খতিয়ে দেখেন না। উল্টো তাঁরা অন্যায় সুবিধা নিয়ে থাকেন। কমিটি মন্তব্য করেছে, অনিয়ম খতিয়ে না দেখার পেছনে কী রহস্য, তা সহজেই অনুমেয়।

কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান গত নভেম্বরে বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) সৈয়দ বেলাল হোসেনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটি তদন্ত শেষে সম্প্রতি এই প্রতিবেদন জমা দেয় গত ডিসেম্বরে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, সবার দেখার দৃষ্টি তো এক রকম নয়। কেউ দেখে টেবিলের ওপর দিয়ে, কেউ দেখে নিচে দিয়ে। না হলে মন্ত্রণালয় দুর্নীতি খুঁজে পেলেও কারাগার দেখভালের দায়িত্বে থাকা ডিআইজিরা কেন কিছু খুঁজে পান না? মন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি কারা অধিদপ্তরকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি।’

তদন্ত কমিটি কুষ্টিয়া জেলা কারাগার পরিদর্শন করেছে গত বছরের ১৬ ও ১৭ নভেম্বর। কিন্তু এর আগে ৬ অক্টোবর ওই কারাগারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা যশোরের ডিআইজি সেখানে গিয়েছিলেন। তাঁর পরিদর্শন প্রতিবেদনে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে আসেনি, বরং কারাগারের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ক্যানটিন’ নিয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল ইতিবাচক। প্রসঙ্গত, জেলা কারাগারগুলো সরাসরি ডিআইজিদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

কুষ্টিয়া কারাগারের জেল সুপার জাকের হোসেন, সদ্য সাবেক কারাধ্যক্ষ এস এম মহিউদ্দিনসহ ৪৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে ক্যানটিনের দুর্নীতি, বন্দী বেচাকেনা, সুস্থ বন্দীদের টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে ভর্তি, সাক্ষাৎ ও জামিন-বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতি আর অনিয়মের প্রমাণ পায় কমিটি। এসব অনিয়ম জেল সুপারের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে হয়েছে। কমিটি বলেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কারাগার থেকে আয় করে প্রধান কারারক্ষী, সিআইডি কারারক্ষী এবং জেল সুপার টাকা ভাগাভাগি করে নেন।

>

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি অনিয়ম খুঁজে পায়, ডিআইজিরা পান না। রহস্য কী?

শুধু যশোরের ডিআইজি নন, প্রায় সব বিভাগের কারা ডিআইজিদের হাল একই। তদন্ত কমিটি উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ঢাকার ডিআইজি গত বছরের ২৮ আগস্ট নরসিংদীর জেলা কারাগার পরিদর্শন করেন। বরিশালের ডিআইজি বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন ২ মার্চ। সিলেটের ডিআইজি মৌলভীবাজার জেলা কারাগার পরিদর্শন করেন ২৪ অক্টোবর। ময়মনসিংহের ডিআইজি জামালপুর জেলা কারাগার পরিদর্শন করেন ২৭ আগস্ট। রংপুরের ডিআইজি রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন ১৬ অক্টোবর।

কমিটি গত বছর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে। কমিটি রাজশাহী কারা প্রশাসনের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আলতাফ হোসেন, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার হালিমা খাতুন, কারাধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান, উপকারাধ্যক্ষ সাইফুল ইসলামসহ ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ পায়। ডিআইজির বিরুদ্ধে বন্দী বেচাকেনা, সুস্থ বন্দীদের টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে ভর্তি, সাক্ষাৎ ও জামিন-বাণিজ্যের অভিযোগ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি এসব অনিয়মের বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। উল্টো দায়িত্বে অবহেলা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ডিআইজির বাসায় আটজন কারারক্ষী, জেল সুপারের বাসায় ছয়জন, কারাধ্যক্ষের বাসায় ছয়জন এবং উপকারাধ্যক্ষের বাসায় চারজন কারারক্ষী ব্যক্তিগত কাজে নিয়োজিত আছেন, যা আইনের পরিপন্থী।

আরেকটি তদন্ত কমিটি চট্টগ্রামের কারাধ্যক্ষের দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের তখনকার ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী, কারাধ্যক্ষ সোহেল রানা বিশ্বাস, সাতজন উপকারাধ্যক্ষসহ ৪৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি খুঁজে পায়। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের কারাধ্যক্ষ সোহেল রানা বিশ্বাসকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত), ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ রেলওয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সোহেল রানার এই অর্থের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির খোঁজ পায় তদন্ত কমিটি।

ডিআইজিদের দেওয়া পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব কারাগারের অনিয়ম বা দুর্নীতির বিষয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়নি। ক্যানটিনের অনিয়ম, বন্দী বেচাকেনা, সাক্ষাৎ-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য, খাবার-বাণিজ্য, চিকিৎসা, পদায়ন, জামিন-বাণিজ্যের মতো দুর্নীতির বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই তাঁদের। তাঁদের দৃষ্টিতে সব ঠিকঠাকভাবে চলছে। এতে সহজেই বোঝা যায়, কারাগারে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে, তা একটি স্বার্থান্বেষী চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। এ চক্রের মধ্যে ডিআইজিদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টিও স্বাভাবিক বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদনে উদাহরণ টেনে বলা হয়, যশোরের ডিআইজি ৬ অক্টোবর কুষ্টিয়া জেলা কারাগার পরিদর্শন করে বলেছেন, সেখানে কোনো অনিয়ম নেই। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তারা কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন হাতেনাতে। এ ছাড়া তদন্ত কমিটির প্রধান সৈয়দ বেলাল হোসেন এর আগে চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাজশাহী কারাগার পরিদর্শন করে একই ধরনের অনিয়ম পেয়েছেন। সব কারাগারের অনিয়মের ধরন একই।

ডিআইজিরা কেন অনিয়ম খুঁজে পান না জানতে চাইলে সৈয়দ বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়, আমি তদন্তে যা খুঁজে পাই, তা তুলে ধরি। এর বেশি বলার এখতিয়ার আমার নেই।’

একই প্রশ্ন করা হলে ঢাকার ডিআইজি টিপু সুলতানের মন্তব্য, ‘আমি যখনই কারাগার পরিদর্শনে যাই, সমস্যা চিহ্নিত করি এবং মৌখিকভাবে তাঁদের সংশোধনের জন্য বলে আসি।’ চট্টগ্রাম ও সিলেটের ডিআইজি এ কে এম ফজলুল হক বলেন, ‘আমাদের কাছে চেকলিস্ট থাকে। আমরা সে অনুযায়ী সবকিছু তল্লাশি করি। ছোট ছোট সমস্যার বিষয়ে মুখে বলে আসি। সিদ্ধান্ত তো নিতে হয় বাস্তবতার আঙ্গিকে।’ বরিশালের ডিআইজি মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পর কারাগার পরিদর্শনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর হয়েছি। আমরা সতর্ক রয়েছি। মন্ত্রণালয়ের মতো আমরাও সারপ্রাইজ ভিজিটে যাচ্ছি। অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে এসেছে। ভালোভাবে দেখে তবেই মন্তব্য করতে পারব। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি যথার্থ বলেছে। অন্তত তারা তো সত্যটা সামনে আনল। তিনি মনে করেন, দেশের সব কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি করা উচিত। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত দোষীদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া।