নকশার বাইরে পাঁচতলা নির্মাণে জড়িত কর্মকর্তারা চিহ্নিত হননি

রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ২৬ জন। ফাইল ছবি
রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ২৬ জন। ফাইল ছবি
>

• গত ২৮ মার্চ এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে
• অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ২৬ জন, আহত ৭৩ জন
• কারণ অনুসন্ধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি
• সম্প্রতি কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে
• নকশার বাইরে টাওয়ারের ওপরের পাঁচতলা নির্মাণ
• এ কাজে কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত

বনানীর এফ আর টাওয়ারের অনুমোদিত নকশার বাইরে অতিরিক্ত পাঁচতলা নির্মাণের সঙ্গে কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। তাঁদের সহযোগিতার কারণেই ১৮ তলার ভবনটি ২৩ তলা করা সম্ভব হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির। অনিয়মে জড়িত ওই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

তবে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী কারা এবং কোন সংস্থার, তা চিহ্নিত করেনি কমিটি। একই সঙ্গে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তাও কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। ভবনের নকশা অনুমোদনের কাজটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ২৬ জন। আহত হন ৭৩ জন। ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদারকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সম্প্রতি কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছে।

তদন্ত কমিটি বলছে, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এফ আর টাওয়ার নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে ১৮ তলার অনুমোদিত নকশা পাওয়া গেছে। কিন্তু ভবনটি ২৩ তলা করা হয়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লাভের আশায় এ কাজ করেছে। এ ধরনের অনিয়ম যাতে না ঘটে, সে জন্য ভবন নির্মাণের পর পরিদর্শন প্রত্যয়নের ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের উৎস ভবনের বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল অষ্টম তলার পূর্ব পাশ থেকে। তবে পূর্ব পাশে কী প্রতিষ্ঠান ছিল, তা প্রতিবেদনে বলা হয়নি। ভবন কর্তৃপক্ষ ও রাজউক সূত্র জানায়, সেখানে বায়িং হাউস ছিল।

প্রতিবেদন বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির সুপারিশ সব সংস্থার কাছে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হবে। ভবনের নকশার অনুমোদনের সময় তা মানা হচ্ছে কি না, তা তদারকির দরকার। এ ছাড়া ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইন মেনে ভবন করছে কি না, তাও দেখা প্রয়োজন। বারবারই দেখা যায়, অবহেলার জন্য বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।

এফ আর টাওয়ারের মতো ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে ২০ দফা সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। প্রথম সুপারিশে ভবনের বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিতভাবে ‘বৈদ্যুতিক অডিট’ করার কথা বলা হয়েছে। অন্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে অগ্নি–প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩-এর সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক ভবন নির্মাতাকে বাধ্য করা। জলাধার বন্ধ করে ভবন নির্মাণ প্রতিহত করা, ওয়াসার প্রতিটি কেন্দ্রে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারের জন্য পানিবাহী গাড়ি মজুত রাখা। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও অগ্নি-প্রতিরোধ আইনে বহুতল ভবনের সংজ্ঞায় যে পার্থক্য রয়েছে, তা দূর করা (ইমারত বিধিমালায় ১০ তলা ভবনই বহুতল ভবন কিন্তু অগ্নি-প্রতিরোধ আইনে বহুতল ভবন বলতে সাততলা ভবনকে বোঝানো হয়েছে)।

বহুতল ভবনসহ প্রতিটি ভবনে অন্তত ১৫ মিনিট যাতে আগুন নিয়ন্ত্রণের নিজস্ব সক্ষমতা থাকে, তা নিশ্চিত করতে বলেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া ভবনের রেলিং কাঠ বা সিমেন্টের হওয়া উচিত বলেও কমিটি মত দিয়েছে। ভবনের আয়তন ও দূরত্ব বিবেচনায় প্রতি তলার ২৩ থেকে ২৫ মিটারের মধ্যে জরুরি নির্গমন পথ থাকতে হবে। রাজউককে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ, ২০০৬ সালের ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। বিএনবিসির গেজেট প্রকাশের আগে যেসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, সেসব ভবনেও বিএনবিসির অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এসব ভবনের অগ্নিঝুঁকি যাচাইয়ের জন্য রাজউককে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

এ ছাড়া বহুতল ভবনগুলোতে নিরাপত্তার জন্য যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের ৬০ শতাংশ কর্মীকে অগ্নিনির্বাপণ ও ভূমিকম্পসংক্রান্ত দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ থাকার কথা সুপারিশে এসেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করবে অনুমোদনপ্রাপ্ত বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশের বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রতিবেদনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তাঁরা সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তির কথা বলেছেন, কিন্তু এ ঘটনার জন্য কারা দায়ী বা দায়দায়িত্ব কাদের ওপর বর্তায়, তা উল্লেখ করেনি। ফলে প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।