নদের তীরের মাটি ইটভাটায়

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় আত্রাই নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশ থেকে ভেকু দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। এসব মাটি বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। গত বৃহস্পতিবার উপজেলার শাহজাদপুর এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় আত্রাই নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশ থেকে ভেকু দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। এসব মাটি বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। গত বৃহস্পতিবার উপজেলার শাহজাদপুর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার শিবগঞ্জ ও শাহজাদপুর এলাকায় স্থানীয় একটি চক্র আত্রাই নদের তীরের মাটি কেটে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় দুই মাস ধরে বাঁধের পাশ থেকে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদের উভয় তীরের মাটি কাটা হচ্ছে। এতে নদের গতি পরিবর্তন ও বর্ষায় তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, আত্রাই নদের পশ্চিম তীরে উপজেলার শাহজাদপুর ও সালতাপুর এলাকায় মহাদেবপুর-ছাতড়া বাঁধের (রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত) পাশ থেকে খননযন্ত্র দিয়ে মাটি কেটে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। ওই স্থান থেকে নদের উল্টো তীরে (পূর্ব পাশে) ১০-১২ জন শ্রমিক কোদাল দিয়ে মাটি কেটে তিনটি ট্রাক্টরে তুলছেন। এসব এলাকায় বাঁধের পাশের জমির উপরিভাগ থেকে তিন থেকে সাত ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি কেটে ট্রাকে ভরে বিভিন্ন ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

শাহজাদপুর এলাকায় বাঁধের পাশ থেকে মাটি কাটার কাজের তদারকি করছিলেন সাইফুল ইসলাম নামের এক তরুণ। তিনি জানান, এখান থেকে মাটি কেটে ‘অর্ডার’ অনুযায়ী বিভিন্ন ইটভাটায় পৌঁছে দেওয়া হয়। মহাদেবপুর সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন নদতীরবর্তী জমির মালিকদের কাছ থেকে মাটি কিনে নিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী এসব জমির উপরিভাগ থেকে মাটি কাটা হচ্ছে।

শিবগঞ্জ মোড়ে মাটি কাটছিলেন শ্রমিক বেলাল, জিয়াউল, রাজীব ও আনারুল। তাঁরা বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে এই বাঁধ এলাকায় মাটি কাটছেন তাঁরা। উপজেলার চেরাগপুর এলাকার সাকলাইন নামের এক ঠিকাদারের নির্দেশে তাঁরা মাটি কাটছেন। এই মাটি সাকলাইনের নিজস্ব ইটভাটা ছাড়াও বিভিন্ন ইটভাটায় নেওয়া হয়। এ ছাড়া অনেক লোক বসতবাড়ি ও রাস্তার কাজে ব্যবহারের জন্য এখান থেকে মাটি কিনে নিয়ে যান।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির অভিযোগ, নদের তীর থেকে মাটি কাটা এই চক্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন। তাঁর সঙ্গে আছেন ঠিকাদার আল আমিন, এরশাদ, সাকলাইন ও রাজ্জাক। তাঁদের প্রায় সবার নিজস্ব ইটভাটা রয়েছে। তাঁরা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই নদের তীরবর্তী জমির মালিকদের কাছ থেকে প্রতি বিঘার মাটি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় কিনে নেন। এরপর মাটি কেটে নিজেদের ইটভাটায় নেওয়ার পাশাপাশি অন্য ইটভাটামালিকদের কাছে বিক্রি করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, ভাটামালিকেরা ক্ষমতাসীন দলের লোক এবং প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকাবাসী মাটি কাটার প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশ থেকে কাটা মাটি ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার শিবগঞ্জ মোড় এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশ থেকে কাটা মাটি ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার শিবগঞ্জ মোড় এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

নদের তীর থেকে মাটি কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘শুধু আমি না, নদের তীর থেকে আরও অনেকেই মাটি কাটছেন। আমি জমির মালিকদের কাছ থেকে মাটি কিনে নিয়েছি। এরপর মাটি কাটছি।’ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি ‘না’ সূচক উত্তর দেন।

গৌতম চন্দ্র, আনন্দ কুমার, বজলুর রশিদ, আনোয়ারসহ আট-নয়জন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, বাঁধের পাশ থেকে খাড়াভাবে মাটি কেটে বিক্রি করায় প্রতি বর্ষায় বাঁধসংলগ্ন পাড়ের মাটি ভেঙে নদে বিলীন হয়ে যায়। এখন যেভাবে মাটি কাটা হচ্ছে, তাতে নদের দুই পাশের রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। আর বাঁধ ভেঙে গেলে যোগাযোগব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের এলাকা তলিয়ে যাবে।

উপজেলার উত্তরগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবিদ হোসেন সরকার বলেন, কিছু কিছু জমির মালিক টাকার বিনিময়ে মাটি বিক্রি করছেন। কিন্তু নদের তীর কাটার অধিকার কারও নেই। নদের তীর কাটার ফলে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। এ ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

পাউবোর নওগাঁ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, মহাদেবপুরে আত্রাই নদের বাঁধের পাশ থেকে মাটি কাটার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ক্ষতি করে নদের তীরের মাটি কাটা অবৈধ। খোঁজ নিয়ে ঘটনার সত্যতা পেলে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ অভিযোগও করেনি। তবে বাঁধের ক্ষতি করে মাটি কাটা খুবই গুরুতর অপরাধ। সরেজমিনে সত্যতা পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’