নাসিরনগরে হামলা ঠেকাতে বুক পেতে দেন যাঁরা

নুর আলম। ছবি: প্রথম আলো
নুর আলম। ছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে বিভিন্ন মন্দিরে হামলা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ভয়ে নিশ্চুপ ছিল এলাকার বেশির ভাগ মানুষ। তবে কেউ কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে গিয়েছিলেন। হিন্দু ভাইদের রক্ষা করতে বুক পেতে দিয়েছিলেন নুর আলম, শেখ তুন্নান, জামাল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন। আল্লাহর দোহাই দিয়ে কারও বাড়িতে ও মন্দিরে হামলা না করতে অনুরোধ করেছিলেন তাঁরা।
স্থানীয় হিন্দু নেতারা বলছেন, এঁদের মতো করে আরও কিছু মানুষ প্রতিরোধ করতে এগিয়ে এলেই সেদিন এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।
ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গত রোববার নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ও ৬০-৭০টি হিন্দু বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে। সেদিন হামলাকারীদের ঠেকাতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ কর্মী নুর আলম। তাঁর মাথায় তিনটি সেলাই লেগেছে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ তুন্নান, স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল মজিদ, নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্টোরকিপার জামাল উদ্দিন আহমেদ, সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল হাশেম, সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল আহাদ, স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক শেখ আসমত আলীসহ আরও কয়েকজন সেদিন হামলাকারীদের প্রতিরোধের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন।

নুর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাজারের ব্যবসায়ী আমার বন্ধু উত্তম দেব মুঠোফোনে জানান, হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হচ্ছে। আমি তখন একটা সেলুনে চুল কাটানোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। খবরটা শুনেই বেরিয়ে পড়ি। বাজারেই দেখা হয় নাসিরনগর ইউপির চেয়ারম্যান আবুল হাশেমের সঙ্গে। তখন তাঁকে নিয়ে দ্রুত গৌরমন্দিরে যাই। সেখানে থানার এসআই সাধন দাস তিনজন কনস্টেবল নিয়ে বসে ছিলেন। তাঁকে বললাম, দাদা, মন্দিরটা রক্ষা করবেন। এরপর আমি কলেজ মোড়ে যাই।’

নুর আলম আরও বলেন, ‘চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে এরপর আমি কলেজ মোড়ে যাই। সেখানে ওসি তদন্তের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এ সময় একটা মিছিলে থাকা বেশ কয়েকজন যুবক দত্তবাড়িতে হামলার কথা বলছিলেন। এই শুনে ওসি তদন্তকে সঙ্গে নিয়ে নাসিরনগর ঈদগাহ দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যাই। সেখানে দেখি, মিছিলকারীরা দত্তবাড়ির দুর্গামন্দিরের দিকে যাচ্ছে। দত্তবাড়ির উত্তর শেষ সীমানার দিকে আমি থানার ওসি আবদুল কাদেরকে পাই। তাঁকে বললাম, আপনি মাইকিং করেন। কিন্তু তখন শত শত মানুষ আসছে।’

নুর আলম বলেন, ‘অবস্থা খারাপ দেখে আমি মন্দিরের সামনে যাই। হামলাকারীদের বলি, ‘আমিও মুসলমানের ছেলে। তোদের আল্লাহর দোহাই। কারও বাড়িতে, মন্দিরে আক্রমণ করিস না।’

কিন্তু নুর আলমের কথা কেউ শোনেনি। নুর আলম বলেন, ‘এর মধ্যেই মিছিল থেকে কয়েকজন এসে আমাকে শার্টের কলার ধরে বেধড়ক পিটানো শুরু করে। এ সময় ওসি বাকি পুলিশ নিয়ে দূরে সরে যান। হামলাকারীরা আমাকে মাটিতে ফেলে মারধর করে। আমার শার্ট ছিঁড়ে যায়। কপাল ফেটে রক্তে পুরো জামা ভিজে যায়। আমি আর পারিনি। পুলিশের কাছে অস্ত্র ছিল। তারা গুলি ছুড়তে পারত।’

হামলাকারীরা কারা ছিল জানতে চাইলে নুর আলম বলেন, ‘বাচ্চা পোলাপান অনেক বাইরে থেকে আসছিল।’

নাসিরনগর সদরের দত্তপাড়ার বাসিন্দা আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ তুন্নানও সেদিন বন্ধুদের নিয়ে হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোববার সকাল সাড়ে ১০টা বা ১১টার দিকে কলেজ মোড়ে সুন্নি-জামাতের (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত) সমর্থকেরা সমাবেশ করছিল। সমাবেশ চলাকালেই কলেজপড়ুয়া ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে দত্তবাড়ির দুর্গামন্দিরের দিকে ছুটতে শুরু করে। তারা তখন বন্ধু আবদুল মজিদ, জামাল উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে দত্তবাড়ির দিকে যায়। পরে পশ্চিমপাড়া থেকে লিটন মিয়া, বোরহান মিয়া, হান্নানসহ আরও কয়েকজন তাদের সঙ্গে যোগ দেন।

শেখ তুন্নান আরও বলেন, হামলাকারীরা দত্তপাড়ার ঈদগাহ মাঠের কোনা থেকে মন্দির লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। একপর্যায়ে তারা মন্দিরের ভেতরে ঢুকে কয়েকটি মূর্তি ভাঙচুরের চেষ্টা করে। তাঁরা সবাই মিলে সেখান থেকে তাদের সরিয়ে দেন। এরপর দত্তবাড়ির একটি গেটে বাঁশ ও আরেকটি গেটে একটি ভ্যান রেখে প্রবেশমুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ২০০ থেকে ২৫০ লোকের আরেকটি দল আবার হামলা চালায়। তারা তাঁদের পেটায়।

শেখ তুন্নানের অভিযোগ, ওই সময় পুলিশ একেবারেই নিষ্ক্রিয় ছিল। বাঁ​শিতে ফুঁ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করেনি তারা।

হামলা ঠেকাতে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্টোরকিপার জামাল উদ্দিন আহমেদও। বললেন, ‘দত্তবাড়ির দুর্গামন্দিরকে রক্ষা করতে গেলে হামলাকারীরা আমার বুকে ঢিল মারে। এরপর আমরা কয়েকজন মন্দির ও হিন্দু পরিবারগুলোকে রক্ষা করতে নমশূদ্রপাড়া, কাশিপাড়ায় যাই। সেখানে তখনো কোনো হামলাকারী আসেনি। আমরা সামনে এগিয়ে ঘোষপাড়ার রাস্তায় দেখি লাঠিসোঁটা হাতে ৫০-৬০ জনের একটি দল। আমরা তখন তাদের বলি, আমরা মুসলমান। এগুলো মুসলমানদের বাড়ি। তারা তখন চলে যায়।’

নাসিরনগরের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল আহাদ বলেন, ‘হামলার খবর শুনে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় আমরা প্রথমে দত্তবাড়ির মন্দিরে যাই। এরপর কাশিপাড়া, সূত্রধরপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোষপাড়া মিন্টু ঘোষের বাড়ি গিয়ে হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করি। কালীমন্দির রক্ষা করতে গিয়ে হামলাকারীদের ঢিলে আমি আহত হই। তখন আমি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু বারবার ফোন করেও পাইনি।’

স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পরিচিত কয়েকজন মিলে চেষ্টা করেছি মন্দিরসহ হিন্দু পরিবারগুলোকে রক্ষা করতে। আল্লাহ ও ইসলামের দোহাই দিলেও তারা আমাদের কথা শোনেনি। উল্টো তারা আমাদের মেরেছে।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাফিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নুর আলমসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী সেদিন প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন।

নাসিরনগর উপজেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি কাজল জ্যোতি দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, এই মানুষগুলো সেদিন হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। অন্যরাও যদি সেদিন তাদের প্রতিরোধ করতেন, বিশেষ করে প্রশাসন ও পুলিশ, তাহলে এত বড় ঘটনা ঘটত না।