নিয়ম ভেঙে সুবিধা নেন তাঁরা

ইউজিসির প্রতিবেদনে আটটি খাতের শিক্ষক, কর্মকর্তাদের অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। দুই অর্থবছরে ক্ষতি ২৭ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তাদের বাড়িভাড়া দেওয়া হয় সিটি করপোরেশন এলাকার নিয়ম অনুযায়ী, যা জাতীয় বেতন স্কেলের পরিপন্থী। ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত বাড়িভাড়া দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে বছরে প্রায় চার কোটি টাকা।

শুধু বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে নয়, আরও আটটি ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। এতে দুই অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিবেদনে অনিয়মের এই চিত্র উঠে এসেছে।

এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট পরীক্ষা করে ১৫ কোটি ৯ লাখ টাকার ক্ষতি নিরূপণ করেছে ইউজিসি।

ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. শাহ আলম স্বাক্ষরিত এই প্রতিবেদনে সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ ফেরত নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট পরীক্ষা করে ১২ কোটি ৯ লাখ টাকা ক্ষতির হিসাব দিয়েছিল ইউজিসি। ফলে দুই অর্থবছরে ক্ষতি হলো ২৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা বলছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। তবে অর্থনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধান ও দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলতে হয় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।

ক্ষতি এবং ইউজিসির সুপারিশের বিষয়ে উপাচার্য শিরীণ আখতারকে ফোন করলে তিনি এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত হিসাব নিয়ামক মো. ফরিদুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

পরে মো. ফরিদুল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউজিসি যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তার কিছু ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাই আগামী অর্থবছরে আশা করা যাচ্ছে এসব ক্ষতি আর দেখা যাবে না।’

ইউজিসি যে সুপারিশ দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করে আইনের প্রয়োগ করতে হবে।
মু. সেকান্দার খান, শিক্ষাবিদ ও ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য

এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে জনগণের অর্থের ওপর। সেই অর্থ নয়ছয় হলে তা মেনে নেওয়া কষ্টের। তাই ভবিষ্যতে এমন অনিয়ম যাতে কেউ না করে, তা নিশ্চিত করতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

সব মিলিয়ে আটটি ক্ষেত্রে জাতীয় বেতন স্কেল, শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩২তম সিনেট সভা। সিনেটে ‘রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট’ শীর্ষক এ বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করা হবে।

নিয়ম ভেঙে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইউজিসি যেসব বিষয়ে আপত্তি তুলেছে, তা আইনের বিবেচনায় হয়তো ঠিক। তবে ন্যায্যতার বিচারে ঠিক নয়।

আরও যত খাতে অনিয়ম

উপাচার্য, ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর, আবাসিক শিক্ষক ও কর্মকর্তারা একাডেমিক অথবা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের স্ব-স্ব মূল বেতনের ৬ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত মাসিক দায়িত্ব ভাতা নেন, যা নিয়ে আপত্তি তুলেছে ইউজিসি। সংস্থাটির দাবি, এভাবে দায়িত্ব ভাতা নেওয়া জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর ২১ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। এতে প্রায় এক কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

জাতীয় বেতন স্কেলের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নম্বর উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা প্রদান সম্পূর্ণ বন্ধ। তাঁদের অর্ধেক কোয়ার্টার ভাড়া ভাতা মাসিক বেতন থেকে কেটে রাখা হয়। বাকি অর্ধেক অবসর নেওয়ার সময় আনুতোষিকের অর্থ থেকে কাটা হয়। কিন্তু এসব নিয়ম না মেনে তাঁদের পূর্ণ বাড়িভাড়া দেওয়া হয়। এতে বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম বিক্রি বাবদ আয়ের সমন্বয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ইউজিসি। ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে আয়ের ৮ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি বাবদ আয় থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব তহবিলে জমা করে বাজেটে সমন্বয় করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত না মানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে দুই কোটি টাকা।

জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য মু. সেকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি স্বেচ্ছাচারীভাবে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অনিয়ম করা হয়, তাহলে এর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ইউজিসি যে সুপারিশ দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। তবেই ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম করার সাহস কেউ পাবেন না।