নূর হোসেনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

প্রিজন ভ্যানে আসামি সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন l ছবি: প্রথম আলো
প্রিজন ভ্যানে আসামি সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন l ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার প্রধান আসামি এবং এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া নূর হোসেনের বিরুদ্ধে আরও ১৩টি মামলা রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে করা একটি মামলায় গত বছর তাঁর এক বছরের কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে।
কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা, উচ্ছেদে বাধা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ ওঠে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে। কাঁচপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জে চাঁদাবাজি, নদী দখল, মাদক ব্যবসাসহ অনেক কিছুরই নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি ও তাঁর লোকজন। দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে বারবার আলোচনায় এসেছেন তিনি।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সূত্র বলেছে, ট্রাকচালকের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা নূর হোসেন পরে চালক হন। ১৯৯২ সালের পর তিনি কৃষক লীগের সাবেক নেতা ও পরে বিএনপির সাবেক সাংসদ গিয়াসউদ্দিনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যোগ দেন বিএনপিতে। পরে তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা সাংসদ শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর তিনি সিদ্ধিরগঞ্জে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ ১৩টি মামলা হয়। বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়ন কাঁচপুর শাখার সভাপতিও হন তিনি। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি এলাকায় ছিলেন না। ওই সময় তিনি ছিলেন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি এলাকায় ফেরেন। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে তিনি ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাজধানীতে প্রবেশের অন্যতম পথ শিমরাইল মোড় ও কাঁচপুরে পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন নূর হোসেন ও তাঁর লোকজন।

পরিবহনে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১২ সালের আগস্টে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে পুলিশ ও র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দেন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। এ ছাড়া চাঁদাবাজির প্রতিবাদে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক ও মালিকেরা নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমাবেশ করেন ও বিভিন্ন জায়গায় স্মারকলিপি দেন। পরে প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর হস্তক্ষেপে ওই চাঁদাবাজি বন্ধ হয়।

নদী দখল ও বিআইডব্লিউটিএর মামলা

বিআইডব্লিউটিএর সূত্র বলেছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কাঁচপুর সেতুর নিচে শীতলক্ষ্যার তীর দখল করে নূর হোসেনদের গড়ে তোলা বালু ও পাথরের ব্যবসা উচ্ছেদ করা হলেও নবম সংসদ নির্বাচনের পর আবারও নদী দখল করে এ ব্যবসা করেন তিনি। হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে শীতলক্ষ্যার তীর অবৈধভাবে দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা গড়ে তোলার অভিযোগে নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে ২০১০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করেছিলেন বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের পোর্ট কর্মকর্তা। মামলায় সরকারি কাজে বাধাদান, সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি দেওয়া এবং নদীতীরের প্রায় ৮০০ শতাংশ জমি দখলের অভিযোগ আনা হয়। গত কয়েক বছরে ওই দখল উচ্ছেদে আট-দশবার অভিযান চালানো হয়। মামলার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ২২টি চিঠি দেওয়া হয়।

মেলার নামে অশ্লীল নৃত্য-জুয়া

অভিযোগ রয়েছে, সাত খুনের ঘটনার আগ পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জে সিটি করপোরেশনের ট্রাক টার্মিনালে এক বছরের বেশি সময় ধরে মেলার নামে চলে অশ্লীল নৃত্য ও জুয়ার আসর। মেলায় অবাধে মাদকও বিক্রি হয়। স্থানীয় কাউন্সিলর নূর হোসেনকে এ মেলা বন্ধ করতে সে সময় সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল মজুমদার চিঠি দিলেও মেলা বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন অশ্লীল নৃত্য ও জুয়ার আসর থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করতেন নূর হোসেনের লোকজন। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকার ভাগ পেতেন স্থানীয় প্রশাসন, সাংবাদিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন স্তরের লোকজন।

নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীদের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল

সাত খুনের পর ২০১৪ সালের মে মাসে জেলা প্রশাসন নূর হোসেন, শাহজালাল বাদল ও তাঁদের সহযোগীদের নামে নেওয়া ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে। নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে লাইসেন্সকৃত অস্ত্র দিয়ে এলাকায় প্রভাব খাটানোর এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহারের অভিযোগ ছিল।

এলাকাবাসী সূত্র বলেছে, নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীদের নিয়ে কমপক্ষে ২০টি গাড়ির বহর চলাচল করত। তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে থাকত লাইসেন্সকৃত অস্ত্রসহ অবৈধ অস্ত্র।