নয়ন বন্ড নেই, তবু মাদক ব্যবসা আছে বরগুনায়

নয়ন বন্ড
ফাইল ছবি।

শরতে লাগাতার বৃষ্টিতে থমকে আছে দক্ষিণের সাগরপারের জেলা বরগুনার জীবনযাত্রা। এমনিতেই ছোট্ট এই শহরটা বেশ শান্ত-সৌম্য ছিল। কিন্তু গত বছর রিফাত শরীফ হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে এই জেলা।

বৃহস্পতিবার বাস থেকে নেমে রিকশায় বরগুনা শহরে যাওয়ার সময় চালক জিজ্ঞেস করেন, ‘কই যাইবেন?’ ডিকেপি এলাকা শুনেই অনেকটা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, ‘ও নয়ন বন্ডের এলাকায়!’

নয়ন বন্ড হলেন রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি, যিনি গত বছর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। ডিকেপি এলাকাতেই বাড়ি ছিল তাঁর।

বরগুনার অবস্থা তুলতেই রিকশাচালক বললেন, ‘এহন মোরা ভালোই আছি। আগে ছিল শহরে, এহন গ্রামেও ছড়াইয়্যা পড়ছে। তয় সবকিছু চলে চুপচাপ।’ কী চলে? প্রশ্ন করতেই তিনি প্যাডেল থামিয়ে ঘুরে তাকান। বলেন, ‘বোঝেন না, গুটি, গুটি।’ গুটি কী? ‘আরে ভাই বোঝেন না, ইয়াবা।’

এই জেলায় মাদকের বিস্তৃতির বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল গত বছর রিফাত শরীফ হত্যার সময়। এর নেপথ্যে ছিল ভয়াবহ মাদক-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ আর মাদককে ঘিরে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং বা সন্ত্রাসী বাহিনী।

রিকশাচালকের কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল শহরের একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথায়ও, ‘আমি যে মহল্লায় বাস করি, সেখানে প্রায় ঘরেই কিশোর-তরুণেরা ইয়াবায় আসক্ত। তারা টাকার জন্য মা-বাবার সঙ্গে ঝামেলা করে। মালামাল ভাঙচুর করে। সব দেখেও ভয়ে মুখ খুলতে পারছি না।’

নয়ন বন্ড নিহত হওয়ার পর জেলায় মাদক কারবারিদের মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। ব্যবসা চলছে কোনো ‘হাউকাউ’ ছাড়া।

শহরে মাদক ব্যবসার স্বরূপ

ডিকেপি সড়কের বাসিন্দাসহ একাধিক সূত্র জানায়, শহরের পশ্চিম অংশে মাদক ব্যবসা নয়ন বন্ডের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাঁর সহযোগী ছিল রিফাত শরীফ হত্যার আসামি দুই ভাই রিফাত ফরাজী ও রিসান ফরাজী। নয়ন বন্ডের মাদক-বাণিজ্য ও সন্ত্রাসী কাজের পেছনে বরগুনা আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। একই মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় শহরের অন্যান্য অংশে মাদক-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক আরেকটি পক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরেই রিফাত হত্যাকাণ্ড—এমন আলোচনা আছে। নয়ন বন্ড নিহতের পর ওই পক্ষই এখন পুরো শহরে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।

একাধিক সূত্রের ভাষ্য, শহরে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতার ছেলে। এই মহল কেবল শহরে নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে দিয়ে এককভাবে ব্যবসা চালাচ্ছে।

জেলার সরকারি ও বেসরকারি একাধিক সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসা পরিচালনার জন্য ওয়ার্ড থেকে পাড়া-মহল্লায় ‘বিক্রয় প্রতিনিধি’ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দেখভালের জন্য আছেন এলাকাভিত্তিক ‘বড় ভাই’। তাঁদের কাজ খুচরা বিক্রয় প্রতিনিধিদের চাহিদা অনুযায়ী ইয়াবা সরবরাহ, অর্থ আদায় এবং টুকটাক ঝামেলা মেটানো। তেমন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ব্যবসা চলে নির্বিঘ্নে।

সূত্রগুলোর ভাষ্য, শহরে মাদকের বড় চালান ঢোকার পর চাহিদা অনুযায়ী বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে কোনো বিক্রয় প্রতিনিধি ধরা পড়লেও অল্পসংখ্যক ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়েন। অল্পদিনেই আইনি প্রক্রিয়ায় কারাগার থেকে বের হয়ে আসতে পারেন তাঁরা। আর মাঠপর্যায়ে থাকা তদারককারী বড় ভাইয়েরা এবং নেপথ্যে থাকা মূল নিয়ন্ত্রকও নিরাপদে থাকেন। কারণ, বড় চালান ধরা পড়ার নজির কম।

সূত্রমতে, এই পক্ষ আমতলী ও তালতলী দুই উপজেলায় ভিন্ন ভিন্ন লোক দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। তবে জেলার পাথরঘাটা, বামনা ও বেতাগীতে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক অন্য পক্ষ।

১ সেপ্টেম্বর সদরের নলটোনা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আবু সালেহকে ইয়াবাসহ আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় সদর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয় এবং দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি।

কয়েক বছর ধরে জেলায় মাদক আটক ও মামলার সংখ্যা কখনো বেড়েছে, আবার কখনো কমছে। এতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে জেলায় মাদকের মামলা হয়েছে ১২৯টি। পরের বছর ২৭২টি। ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৫৫৩টি। আবার ২০১৭ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৭০৩টি। ২০১৮ সালে কিছুটা কমে হয়েছে ৬৯৪টি। ২০১৯ সালে তা আরও কমে হয়েছে ৪৭৯টি। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মামলা মাত্র ৭৯টি।

পুলিশের ভাষ্য, গত বছরের জুনে রিফাত শরীফ হত্যার পর পুলিশের ব্যাপক তৎপরতায় মাদক ব্যবসা স্তিমিত হয়ে আসে। পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে।

তবে বরগুনায় নাগরিকদের সংগঠন পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসান ঝন্টু মনে করেন, করোনাকালে মাদকবিরোধী অভিযানের দিকে পুলিশের মনোযোগ ছিল কম। এ কারণে মাদক কম উদ্ধার হয়েছে এবং মামলাও কম হয়েছে। তাঁর ভাষ্য, মাদক ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় নানা কৌশলে অপকর্ম করে যাচ্ছেন।

স্তিমিত আ.লীগের রাজনীতি

রিফাত শরীফ হত্যার ঢেউ বরগুনার স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি অনেকটাই স্তিমিত করে দেয়। এক শীর্ষ নেতার ভায়রার দুই ছেলে এই হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় এবং অপর এক শীর্ষ নেতার ছেলেকে নিয়ে বিতর্ক দলীয় রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ। এরপর দলীয় কর্মকাণ্ডে আর প্রাণ ফেরেনি। এর রেশ না কাটতেই আসে করোনাভাইরাস।

এই স্থবিরতার পেছনে মাঠপর্যায়ে মাদকের বিস্তার আর রিফাত হত্যা এবং এর কয়েক মাস আগে যুবলীগের কর্মী বাদশা মৃধা (৩০) হত্যাকাণ্ডকে দায়ী করেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। গত বছরের ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শহরতলির কামড়াবাদ বাজারে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বাদশাকে।

যেসব নেতা-কর্মীর নামে মাদক-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এসেছে, তাঁদের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব মৃধা। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ব্যর্থতা।’ এই নেতা বলেন, ‘নয়ন বন্ড দলের লোকজনকে পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠেছিল। বিষয়টি আমাদের বিব্রত করেছে।’ এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির।

তবে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ মাদকের বিস্তার নিয়ে ‘বিব্রত’ হলেও সাধারণ মানুষ এর ভয়াবহতা নিয়ে আতঙ্কে আছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠেও শোনা গেল এমন উদ্বেগের কথা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ভয় পাইনি। কিন্তু এখন কথা বলতে ভয় লাগে। শহরের অলিগলিতে যেভাবে ইয়াবার ছড়াছড়ি, তাতে এসব কিশোর-তরুণের কাউকে সুস্থ মনে হয় না। পুরো প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে।’