পাঁচ বছরে থানায় ২৬,৬৯৫টি ধর্ষণের মামলা

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

গত ৫ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। পুলিশপ্রধানের পক্ষে হাইকোর্টে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এ হিসাব ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, থানায় ধর্ষণের মামলা দায়েরের সংখ্যা বাড়ছে। যার মধ্যে গত দুই বছরে বেশি মামলা হয়েছে।

বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ বুধবার এ প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি নিয়ে আদালত আগামী ২৩ মে পরবর্তী আদেশের জন্য তারিখ রেখেছেন।

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনায় দেশের থানাগুলোতে মামলা দায়েরের সংখ্যা বাড়ছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ৩৩১টি। ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৬৮৩টি। ২০১৮ সালে হয় ৪ হাজার ৬৯৫টি মামলা। ২০১৯ সালে ৬ হাজার ৭৬৬টি মামলা করা হয়। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগে ৬ হাজার ২২০টি মামলা হয়েছে। সব মিলিয়ে গত ৫ বছরে থানায় দায়ের হওয়া ধর্ষণের মামলা ২৬ হাজার ৬৯৫টি।

ধর্ষণের মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা, সালিস বা মীমাংসা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এবং ইতিপূর্বে এ বিষয়ে দেওয়া তিনটি রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়ন চেয়ে গত বছরের ১৯ অক্টোবর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে একটি রিট করা হয়। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২১ অক্টোবর হাইকোর্ট রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন।

সেদিন হাইকোর্ট ধর্ষণের ঘটনায় মধ্যস্থতা, সালিস বা মীমাংসা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনায় গত পাঁচ বছরে সারা দেশের থানা, আদালত ও ট্রাইব্যুনালে কতগুলো মামলা হয়েছে, তা জানিয়ে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সে অনুসারে পুলিশপ্রধান (আইজিপি) ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ প্রতিবেদন দাখিল করে।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী অনীক আর হক, ইয়াদিয়া জামান, মো. শাহীনুজ্জামান ও সৈয়দা নাসরিন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এম এম জি সারোয়ার।

প্রতিবেদন উপস্থাপন

শুনানিতে আইজিপির প্রতিবেদনের অংশবিশেষ তুলে ধরে আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, ধর্ষণের ঘটনা প্রতিবছর বাড়ছে। থানায় ৫ বছরে ২৬ হাজার ৬৯৫টি মামলা হয়েছে। তার বাইরে ট্রাইব্যুনালেও মামলা হয়। বাকিদের কাছ থেকে প্রতিবেদন আসেনি।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের প্রতিবেদন তুলে ধরে আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, হাইকোর্টের ইতিপূর্বের রায়ের নির্দেশনা অনুসারে মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। গত ১৮ নভেম্বর এই সেল গঠন করা হয়। হাইকোর্টের তিনটি রায় ছিল। এসব রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ আদালতের আদেশের পরই তা করা হয়েছে।

শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পাঁচ বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ও থানায় কতগুলো ধর্ষণ–সম্পর্কিত মামলা করা হয়েছে, সেই তথ্য পাঠানোর জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। আইজিপি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট বিচারক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল থেকে তথ্য এলে পরবর্তী প্রতিবেদন দেওয়া যাবে। এ জন্য দুই মাস সময়ের আরজি জানান তিনি। শুনানি নিয়ে আদালত আগামী ২৩ মে পরবর্তী তারিখ রাখেন।

রিটের পূর্বাপর

রিটে তিনটি মামলায় ইতিপূর্বে উচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনার প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়, কোনো ধরনের দেরি না করে ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ এমন প্রতিটি আমলযোগ্য অপরাধ যেখানেই ঘটুক না কেন, তার তথ্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে লিপিবদ্ধ করতে হবে। ১৮ দফার নির্দেশনায় বলা হয়, ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের সব ঘটনায় বাধ্যতামূলকভাবে কেমিক্যাল বা ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে। ডিএনএ পরীক্ষা ও অন্যান্য পরীক্ষার নমুনা নির্ধারিত ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাব বা ডিএনএ প্রোফাইলিং সেন্টারে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাঠাতে হবে।
একই বছরের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট এক আদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা নির্ধারিত ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ না হলে জবাবদিহি–সংক্রান্ত আইনের ৩১ক যথাযথভাবে অনুসরণ করতে বলেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তাকে (পুলিশ) এ নির্দেশ দেন আদালত। এ বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন করা না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়।

সবশেষ ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই হাইকোর্ট এক আদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ধর্ষণ ও ধর্ষণ–পরবর্তী হত্যা মামলাগুলো আইন নির্ধারিত ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করতে, মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে তদারকি কমিটি গঠন করতে এবং জবাবদিহি নিশ্চিতে ছয় দফা নির্দেশনা দেন।

রিটকারীর আইনজীবীর ভাষ্য, ধর্ষণের ঘটনায় আইনি বিধিবিধান অনুসরণ ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষা এবং যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিতে ইতিপূর্বে হাইকোর্ট তিনটি মামলায় রায় দেন। তবে রায়ের নির্দেশনার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। এমন প্রেক্ষাপটে রিটটি করা হয়।
আসকের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২১ অক্টোবর হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দিয়েছিলেন। রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না এবং অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে ধর্ষণ ঘটনায় সালিস রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়।