পান্থপথে অভিযান, জঙ্গি আত্মঘাতী

রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে গতকাল আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে এক ‘জঙ্গি’ নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছেন সিআইডির সদস্যরা l ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে গতকাল আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে এক ‘জঙ্গি’ নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছেন সিআইডির সদস্যরা l ছবি: প্রথম আলো

জাতীয় শোক দিবসের সকালে রাজধানীর পান্থপথের একটি আবাসিক হোটেলে পুলিশের অভিযানের সময় বিস্ফোরণে সন্দেহভাজন এক জঙ্গি নিহত হয়েছেন। জাতীয় শোক দিবসের র‍্যালিতে হামলার উদ্দেশ্যে ওই জঙ্গি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কাছের এই হোটেলে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে পুলিশপ্রধান জানিয়েছেন।

গতকাল সকাল সাড়ে ছয়টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে যখন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন, তখন সেখান থেকে চার-পাঁচ শ মিটার দূরে ওই ভবন ঘিরে অভিযান চালাচ্ছিলেন পুলিশ ও সোয়াট সদস্যরা।

অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিহত যুবক নব্য জেএমবির সদস্য। অভিযানের সময় আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তিনি ‘সুইসাইড ভেস্টে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী’ হয়েছেন।

‘অপারেশন অগাস্ট বাইট’ নামের ওই অভিযানে নিহত যুবকের নাম সাইফুল ইসলাম। তাঁর বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর সাইফুল খুলনা বিএল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ওই কলেজে তিনি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। সাইফুলের বাবা আবুল খায়ের মোল্লা জামায়াতে ইসলামীর ইউনিয়ন শাখার কোষাধ্যক্ষ। সাইফুল নিজেও ছাত্রশিবিরের কর্মীদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। সবশেষ গত শুক্রবার গ্রাম ছাড়েন তিনি।

আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, কাউন্টার টেররিজমের গোয়েন্দাদের কাছে খবর ছিল, ৩২ নম্বরকে কেন্দ্র করে যেসব মিছিল আসবে, সেই মিছিলে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাবে জঙ্গিরা। শত শত লোক মেরে ফেলার প্রস্তুতি ছিল তাদের। এ খবরের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্টার টেররিজমের সদস্যরা পান্থপথ এলাকায় নজরদারি শুরু করেন। অবশেষে একজনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তিনি আরও বলেন, পুলিশ ওই জঙ্গিকে আত্মসমর্পণ করতে বললেও তিনি আত্মসমর্পণ করতে রাজি হননি। বাধ্য হয়ে পুলিশ যখন অভিযান শুরু করে, তখনই তিনি বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এতে হোটেলের দরজা উড়ে যায়। আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর আগেই পুলিশ গুলি করে। সাইফুল এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা সুইসাইড ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটান। আইজিপি বলেন, খুলনার বিএল কলেজের ছাত্র সাইফুল ছাত্রশিবির করতেন। জামায়াত-শিবির না হলে জাতির জনকের মৃত্যুর দিন জাতীয় শোক দিবসে এমন পরিকল্পনা তিনি নিতে পারতেন না।

সাইফুল ইসলাম
সাইফুল ইসলাম

যেভাবে অভিযান
পান্থপথের যে হোটেলে অভিযান হয়, তার নাম ওলিও ইন্টারন্যাশনাল। স্কয়ার হাসপাতালের পশ্চিমে চার-পাঁচটি ভবনের পরই এর অবস্থান। হোটেলের উল্টো দিকের একটি ভবনে তিনটি বাসের টিকিট কাউন্টার। একটি কাউন্টারের কর্মী মো. সুজন প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার দিবাগত রাত দেড়টা-দুইটা থেকে এলাকায় পুলিশের আনাগোনা বেড়ে যায়। তাঁদের ধারণা ছিল, ১৫ আগস্ট উপলক্ষে পান্থপথ এলাকায় এমনিতেই জোরদার নিরাপত্তা থাকে। এটা তারই অংশ হতে পারে। এরপর রাত সাড়ে তিনটার পরে পান্থপথ এলাকায় আরও পুলিশ আনা হয়। তাঁরা কাউন্টারের কর্মীদের বের হতে নিষেধ করেন। অভিযানের সময় তাঁরা কাউন্টারেই ছিলেন।

ঘটনাস্থলে গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউকে কেন্দ্র করে জঙ্গি হামলা হতে পারে, এমন একটা খবর ছিল। গোয়েন্দা বাহিনী প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে খোঁজখবর রাখছিল। পুলিশ রাজধানীর কয়েকটি স্পর্শকাতর জায়গায় কয়েক দিন ধরে রেকি করে আসছিল।

পুলিশ সদর দপ্তরের কাউন্টার টেররিজম ফোকাল পয়েন্ট মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পাঁচ-সাত কিলোমিটারের মধ্যে হামলা হতে পারে সন্দেহ করে কলাবাগান থানার পুলিশ এলাকার হোটেল ও মেসগুলোতে ব্লক রেইড করছিল। সোমবার দিবাগত রাতে তাঁরা হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের প্রতিটি ঘরেও তল্লাশি করেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানিয়েছিল, সোমবার রাত নয়টায় সাইফুল হোটেলে উঠেছিলেন। রাত দুইটার দিকে তাঁরা সাইফুল ইসলামের কক্ষে ধাক্কা দিলে তিনি দরজা খুলতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। পরে দরজা খুলে বলেন, যা বলার সকালে বলবেন। এরপর পুলিশ বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়। রাত সাড়ে তিনটার দিকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ঘটনাস্থলে আসে। তারা সাইফুলকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করে। কিন্তু তিনি বের হননি। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা পর্যন্ত কোনো রকম অভিযান না করার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ।

হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনাল যে ভবনে, সেই একই ভবনে আসবাবের বড় দোকান, বাস কাউন্টার এবং টায়ার-টিউবের দোকান রয়েছে। উল্টো পাশে রেস্তোরাঁ, শপিং মল, বেসরকারি হাসপাতাল ও মানুষের ঘরবাড়ি। জায়গাটি ঘনবসতিপূর্ণ। জাতীয় শোক দিবসের ছুটি উপলক্ষে স্থানীয় বাসিন্দারা ঘরেই ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সড়কে বিপুলসংখ্যক পুলিশ দেখে ভড়কে যান। অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেকে ভিড় করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে পুলিশ হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের দিকে গুলি ছোড়ে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়। কিছুক্ষণ পর হোটেলের চারতলার দেয়াল ধসে পড়ে। পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর মুহুর্মুহু গুলির শব্দ পাওয়া যায়। সকাল ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কয়েকজন কর্মী আহত অবস্থায় পাঁজাকোলা করে এক ব্যক্তিকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর পরিচয় জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি একজন পথচারী বা কোনো ভবনের নিরাপত্তারক্ষী। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর সকাল সোয়া ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি, বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঘটনাস্থলে প্রবেশ করেন।

বেলা ১১টার দিকে পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্য ও অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন যে কক্ষে সাইফুল ইসলাম ছিলেন সেই কক্ষে যান। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, কক্ষটিতে একজন জঙ্গিই ছিলেন। তাঁর কাছে বোমা ছিল। কক্ষে একটি চামড়ার ব্যাগ রয়েছে। সেখানেও বিস্ফোরক রয়েছে। বিস্ফোরকগুলো কী ধরনের, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। অভিযানের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেয়ালের ভাঙা টুকরো, পুড়ে যাওয়া তোশক, বালিশ, লুঙ্গি, প্লাস্টিকের একটি ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বেলা তিনটা পর্যন্ত বিধ্বস্ত হোটেলের বারান্দা থেকে পুড়ে যাওয়া এক জোড়া পা ঝুলে থাকতে দেখা যায়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মৃতদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।

শুক্রবার বাড়ি ছাড়েন সাইফুল

খুলনা প্রতিনিধি জানান, নিহত সাইফুল ইসলাম চাকরি খোঁজার কথা বলে গত শুক্রবার বিকেলে খুলনার ডুমুরিয়ার সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাটি গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় রওনা দেন। সাইফুলের ছোট বোন ইরানি খাতুন বলেন, দুই দিন আগে রোববার বিকেলে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। এরপর আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।

সাইফুলের গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁর বাবার নাম আবুল খায়ের মোল্লা। তিনি নোয়াকাটি গ্রামে মাঠের হাট মসজিদের ইমাম। সাইফুলের মা বাক্প্রতিবন্ধী। আবুল খায়েরের এক ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সাইফুল সবার বড়। পাইকগাছার একটি মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পাস করেন। বিএল কলেজে পড়াশোনার জন্য তিনি খুলনার একটি মেসে থাকতেন। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের দাখিল পরীক্ষায় সাইফুলের রেজিস্ট্রেশন কার্ডে তাঁর জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৯৬ সালের ১৩ অক্টোবর। এই হিসাবে তাঁর বয়স প্রায় ২১ বছর।

নোয়াকাটি গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়ি এলেও সাইফুল কারও সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করতেন না। আচরণেও কেউ অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি।

সাইফুলের বোন ইরানি খাতুন বলেন, চাকরি না করার কারণে শুক্রবার তাঁর বাবা আবুল খায়ের সাইফুলকে বকা দেন। এরপর শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলেন তিনি। বিকেলে বাড়ি ছাড়েন। রোববার ফোন করে সাইফুল জানান যে তিনি সোমবার বিকেলে গ্রামে ফিরে আসবেন। গতকাল সকালে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে সাইফুলের নিহত হওয়ার খবর পান তাঁরা।

ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিল হোসেন জানান, গতকাল সকালে সাইফুলের বাবা আবুল খায়েরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়েছে।