পাহাড় কাটছেন জনপ্রতিনিধিরা

চকরিয়ার মহছিনিয়াকাটা এলাকায় দিনের বেলায় এভাবে কাটা হচ্ছে পাহাড়। ১২ ডিসেম্বর বেলা তিনটায় তোলা ছবি।  প্রথম আলো(6)
চকরিয়ার মহছিনিয়াকাটা এলাকায় দিনের বেলায় এভাবে কাটা হচ্ছে পাহাড়। ১২ ডিসেম্বর বেলা তিনটায় তোলা ছবি। প্রথম আলো(6)

কক্সবাজারের সাত উপজেলায় এক বছরে অন্তত ১৫০টি স্থানে পাহাড় কাটা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ এসব পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যে এবং সরেজমিন অনুসন্ধানে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

রামু দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান ইউনুছ ভুট্টো, কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর ইউনিয়নের বিএনপির চেয়ারম্যান আবুল কালাম, তাঁর ভাই আওয়ামী লীগ নেতা মো. শরীফ, উখিয়া হলদিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম, উখিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ উঠেছে। শাহ আলম উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের সমর্থক।

এ ছাড়া চকরিয়ার ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ ও আবদুস সালাম, সদরের মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাঁচ মাসে প্রায় ২০০টি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে খুনিয়াপালং ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জম হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ পাহাড় কাটছেন। এর মধ্যে জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদও রয়েছেন। অনেকেই জরিমানার শিকার হয়েছে। এই কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে বান্দরবানের ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। লাইনটি ১২ ফুট উঁচু করার জন্য কিছু পাহাড় কাটা হচ্ছে। কিন্তু রেললাইনের নাম দিয়ে অনেকে অননুমোদিতভাবে পাহাড় কাটছে।

সরেজমিন
কক্সবাজারের সাতটি উপজেলার পাহাড়, টিলা, পাহাড়ি বন কাটা রোধে এবং সমুদ্রসৈকত রক্ষার বিষয়ে ৯ ডিসেম্বর রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে দেওয়া রুলে পাহাড়, পাহাড়ি বন, টিলাকে কোনো ধরনের পরিবর্তন, রূপান্তর, কাটা থেকে রক্ষার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ২২ বিবাদীকে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। 

এরপরও থেমে নেই পাহাড় কাটা। অনেকগুলোর খবর পরিবেশ অধিদপ্তর হয়তো জানেও না। চকরিয়ার বরইতলী, মহছিনিয়াকাটা, প্রস্তাবিত রেললাইনের আশপাশে বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কাটা চলছে। গত ১১ ডিসেম্বর চকরিয়ার মহছিনিয়াকাটা এলাকায় এক্সকাভেটর দিয়ে পাহাড় কাটতে দেখা গেছে। এর পাশে কয়েকটি ঘর রয়েছে। একটি এক্সকাভেটর ও ডাম্প ট্রাক সেখানে ছিল।

জানা গেছে, মো. নাছির উদ্দিন নামের এক পরিবহনমালিক এই পাহাড় কেটে মাটি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। জানতে চাইলে মুঠোফোনে নাছির উদ্দিন দাবি করে বলেন, ‘আমার তিনটি ডাম্প ট্রাক রয়েছে। সেগুলো মাঝেমধ্যে অনেকে ভাড়া নেয়। কে পাহাড় কাটছে জানি না।’ সেখান থেকে নির্মীয়মাণ রেললাইনের পাশ ধরে যাওয়ার সময় দেখা যায়, পাহাড় কাটার উৎসব চলছে।

জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
গত পাঁচ মাসে শতাধিক ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়েছে। রামুর বলিপাড়ায় পাহাড় কাটার অভিযোগে ইউনুছ ভুট্টোকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

কক্সবাজারের ইসলামপুর ইউনিয়নের নাপিতখালী এলাকায় নভেম্বরে ১২ লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অভিযোগ ওঠে ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম, তাঁর ভাই আওয়ামী লীগ নেতা মো. শরীফসহ সাতজনের বিরুদ্ধে।

আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা ঘরবাড়ি করেছে, তারা সেখানে পাহাড় কাটতে পারে। আমার বিষয়টা পুনরায় তদন্ত করতে অনুরোধ করেছি।’

উখিয়ার হলদিয়া পালং এলাকায় সাড়ে ১৩ লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অভিযোগে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ও ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলমকে নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’ শাহ আলম বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ছাড়া পাহাড় কোনোভাবে কাটা যাবে না। কিন্তু কক্সবাজারে যে হারে প্রতিদিন পাহাড় কাটা হচ্ছে, তা জরিমানা করে, ট্রাক এবং শ্রমিক আটক করে রোধ করা যাবে না। এ জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সচেতন করতে হবে।