বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ভাঙিয়ে যা করতেন তাঁরা

বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া মনসুর আহমেদ ও মহসিন চৌধুরী
ছবি: র‌্যাবের সৌজন্যে

বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ও পরিচয় ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করতেন চক্রের মূলত হোতা মনসুর আহমেদ (৩৩)। গতকাল মঙ্গলবার রাতে এই অভিযোগে র‌্যাব রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মনসুর ও তাঁর অন্যতম সহযোগী মহসিন চৌধুরীকে আটক করেছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন দলিল ও ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট উদ্ধার করা হয়। এই দুজন সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন ও নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন।

আজ বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) কাছ থেকে র‌্যাব তথ্য পায়, প্রতারক ও জালিয়াত চক্র বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ও পরিচয় ভাঙিয়ে প্রতারণা করছে।

তারা সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন এবং নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নেওয়া চেষ্টা করছে। ওই তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল রাতে র‌্যাব ও এনএসআই রাজধানীর পল্টন এলাকায় থেকে প্রতারক চক্রের মূল হোতা মনসুর আহমেদ ও তাঁর সহযোগী মহসিন চৌধুরীকে আটক করে। এ সময় তাঁরা প্রতারণায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন র‌্যাবের পরিচালক খন্দকার আল মঈন
ছবি: র‌্যাবের সৌজন্যে

খন্দকার আল মঈন বলেন, আটক ব্যক্তিরা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। এই চক্রে পাঁচ থেকে সাতজন সদস্য রয়েছে। মনসুরের নেতৃত্বে চক্রটি তিন থেকে চার বছর ধরে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রতারিত করে আসছে। তাঁরা প্রতারণার জন্য বিভিন্ন সময় নতুন কৌশল ব্যবহার করতেন। তাঁরা নতুন সিম কার্ড কিনে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামে সেভ করতেন। প্রতারকেরা ওই সব ব্যক্তি সেজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চ্যাটিং করতেন। চক্রের সদস্যদের বিভিন্ন মুঠোফোন নম্বর চক্রের মূল হোতা ও সহযোগীর মুঠোফোনে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নাম ও ছবি দিয়ে সেভ করতেন। পরে তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে চ্যাটিং করতেন। এই চ্যাটিং কনটেন্ট তাঁরা এমনভাবে তৈরি করেন, যাতে যেকোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনে করে, এর আগে অনেক কাজ তাঁরা অর্থের বিনিময়ে পাইয়ে দিয়েছেন এবং তাঁদের বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুবই সুসম্পর্ক রয়েছে।

এ চক্রের এক সদস্য কথিত সাইফুল বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছেন। তিনি নিজেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পরিচয় দিতেন। সাইফুল আরব আমিরাতে বসে বসে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতেন বলে আটক ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন। নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে তাঁরা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁদের ছবি আগ্রহী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেখাতেন। নিজেদের কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য হিসেবে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে তাঁরা হাজার হাজার কেটি টাকার ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি দেখাতেন। তাঁরা কোনো অফিসে মিটিংয়ের সময় দামি গাড়ি ও দেহরক্ষী নিয়ে নিজেদের উপস্থাপন করতেন। নিজেদের আরও বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করার জন্য তাঁরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য ভ্রমণ করেছেন বলে বিভিন্ন ছবি দেখাতেন।

সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, আটক ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে বলেছেন, তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা অধিকতর প্রমাণের জন্য চলমান সরকারি প্রকল্পগুলোয় অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন বলে ওই সব প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করতেন। তাঁরা বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা ভুয়া চুক্তিপত্র, ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি দেখাতেন। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে চক্র কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

আরও পড়ুন

চক্রটি বর্তমানে তিতাস নদী ড্রেজিং, আড়িয়াল খাঁ নদ ড্রেজিং ও নদীর তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প, ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের ড্রেনের সংস্কারকাজ, রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি অফিস কনস্ট্রাকশনের কাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশনের কাজসহ প্রভৃতি উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারণার পরিকল্পনা করছিল বলে আটক ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন। চক্রের সদস্যরা প্রতারণা করে দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে।

র‌্যাব জানায়, মনসুর প্রথমে চাঁদপুর জেলার নিজ এলাকায় জমির দালালি করতেন। পরে তিনি ঢাকায় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। সেখানে কর্মরত অবস্থায় প্রতারণার বিষয়টি তাঁর মাথায় আসে। পরে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সাইফুলের সঙ্গে পরিচয় হলে তিনি প্রতারণার জন্য চক্রটি গড়ে তোলেন। আটক মহসিনের রাজধানীর মালিবাগে পোশাক কারখানা ছিল। লোকসান হওয়ায় একপর্যায়ে তিনি কারখানাটি বেচে দেন। পরে মতিঝিলে মনসুরের সঙ্গ পরিচয় হয় এবং প্রতারক চক্রের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন।