বাঁশখালীর সংঘর্ষের পেছনে 'তিন কারণ'

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারায় সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার তিন দিন পর স্থানীয় সাংসদ এ ঘটনার জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘রাজনৈতিক ইন্ধন’, ‘চাঁদাবাজি’ এবং সহজ-সরল মানুষকে ‘ভুল বোঝানো’। এ তিনটি বিষয়ের জন্য গণ্ডামারার বসতভিটা ও গোরস্থান রক্ষা কমিটির আহ্বায়ককে দায়ী করেছেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম শহরের রহমান নগর এলাকায় নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তবে গতকাল পর্যন্ত সাংসদ ঘটনাস্থলে যাননি।
সাংসদের করা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গণ্ডামারার বসতভিটা ও গোরস্থান রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক লিয়াকত আলী।
এদিকে বাঁশখালীতে প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্যাডে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে ‘উন্নয়নের নামে প্রাণহরণ বন্ধ’ করার কথা বলা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংসদের দাবি, ঘটনার দিন এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু লিয়াকতের লোকজন অস্ত্রশস্ত্র-লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশ ও নিরীহ লোকজনের ওপর হামলা চালায়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
তবে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা এর আগে অভিযোগ করেন, পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাংসদ দাবি করেন, ‘এগুলো পুলিশের গুলি নয়। এগুলো ছররা গুলি। লিয়াকতের সহযোগীদের গুলিতেই লোকজন মারা গেছেন।’
এ বিষয়ে লিয়াকত আলী বলেন, সেদিন পুলিশের গুলিতেই চারজন নিহত হন। আন্দোলন থামাতে এবং ঘটনা ধামাচাপা দিতে এখন তাঁকে দোষারোপ করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সাংসদ মোস্তাফিজুর দাবি করেন, ‘লিয়াকতসহ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকল্পের বিরুদ্ধে এলাকার জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে। প্রচারণা চালিয়ে প্রকল্পের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টির তৎপরতা চালিয়েছে।’ সাংসদের ভাষ্য, প্রকল্পের ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি ছিল না। তাঁর জানামতে, প্রকল্পটির পরিবেশ ছাড়পত্রও রয়েছে। শুক্রবারের মধ্যে প্রকল্পটি বাতিলের ব্যাপারে এলাকাবাসীর দাবির বিষয়ে সাংসদ বলেন, কিছু লোকের জন্য প্রকল্প কেন বন্ধ হবে?
সাংসদের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গফুর, বাঁশখালী পৌরসভার মেয়র শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী, উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেহেনা আক্তার প্রমুখ।
সাংসদের করা বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করে লিয়াকত গতকাল দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার পরিবেশের ক্ষতি হবে, তাই লোকজন আন্দোলন করছে। কাউকে ভুল বুঝিয়ে নয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনিও আন্দোলন করছেন।
এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে গণ্ডামারা ইউনিয়নে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। গত সোমবার গণ্ডামারার হাদিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে-বিপক্ষের লোকজন সমাবেশ ডাকেন। এ নিয়ে সংঘর্ষে দুই ভাইসহ চারজন নিহত হন। এ ঘটনায় বাঁশখালী থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় লিয়াকতসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় তিন সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
প্রাণহানির প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে বাঁশখালী আইনজীবী কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। কর্মসূচিতে বক্তারা প্রাণহানির ঘটনার জন্য বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। সংগঠনের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী, ফেরদৌস আহমেদ, আবদুস সাত্তার, এনামুল হক, অশোক কুমার দাশ, দীন মণি দে, আবুল কাশেম চৌধুরী, নাছির উদ্দিন, ইফতেখার মহসিন, মো. আলী প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘মানুষ মেরে বিদ্যুৎ চাই না। প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সেদিন প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না।’ গণ্ডামারার নিরীহ গ্রামবাসীকে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনেরও ঘোষণা দেন তাঁরা।
এদিকে গণ্ডামারায় গতকালও বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক পালন করেছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী পক্ষের লোকজন। দুপুরে সেখানে যান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল্লাহ কবির। তিনি বলেন, এলাকাবাসীকে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে দিলে কোনো অসুবিধা হতো না।
গতকাল বিকেলে গণ্ডামারা বাজারে যান চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এ কে এম হাফিজ আক্তার। সেখানে স্থানীয় লোকজন তাঁর কাছে অভিযোগ করেন, পুলিশের ভয়ে তাঁরা বাইরে বের হতে পারছেন না। জবাবে তিনি গ্রামবাসীকে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে অনুরোধ করেন। নিরীহ কাউকে হয়রানি করা হবে না বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।
বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, প্রকল্পটি বাতিলের ঘোষণা দেওয়া না হলে আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর তাঁরা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
বাঁশখালীতে প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশিষ্ট নাগরিকেরা এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন। বিবৃতিতে বাঁশখালীর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো সাধারণ জনগণের জীবন ও জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন প্রকল্প বাতিলের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়ী সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন প্রমুখ।
বাঁশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে সংঘর্ষে প্রাণহানির বিষয়ে গতকাল ঢাকায় বিদ্যুৎ ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এটি সরকারের কোনো বিষয় নয়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে। তারা সেখানে জমি অধিগ্রহণ করেছে। এখন তারা যদি মনে করে, হতাহতের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান পরিবর্তন করবে, সে ক্ষেত্রে সরকার কোনো আপত্তি করবে না। আবার বাঁশখালীতে করতে চাইলেও সরকারের আপত্তি থাকবে না। তবে হতাহতের ঘটনা তদন্ত সাপেক্ষে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে বাঁশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।