বান্দরবানে হত্যা-অপহরণে আতঙ্ক

বান্দরবান সদরের দুই ইউনিয়ন রাজবিলা ও কুহালংয়ে ১৬ দিনের ব্যবধানে খুন হয়েছেন তিনজন। অপহৃত হন দুজন। এ নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে এই দুই ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে। বেশির ভাগ গ্রাম অনেকটা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। নারী-শিশুরাও ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়।

সর্বশেষ গত বুধবার কুহালংয়ের উজিমুখ হেডম্যানপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতা চথুইমং মারমার অপহরণের ঘটনায় বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। 

আওয়ামী লীগ ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

দুই ইউনিয়নে প্রায় ৩৮ হাজার মানুষের বসতি। ইউনিয়ন দুটির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৪ এপ্রিল রাজবিলার তাইংখালী বাজারে জেএসএসের এক নেতাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তখন থেকে পাল্টাপাল্টি হত্যা-অপহরণ শুরু হয়েছে। এরপর ৭ মে একই এলাকায় জেএসএসের কর্মী বিনয় তঞ্চঙ্গ্যাকে খুন এবং খোলাধন তঞ্চঙ্গ্যাকে অপহরণ করা হয়। ৯ মে ৩ নম্বর রাবারবাগান পাড়ায় জেএসএসের কর্মী জয়মণি তঞ্চঙ্গ্যাকে হত্যা করা হয়।

জেএসএসের কর্মী খুনের জন্য মগ পার্টি নামধারী দলছুট আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) সশস্ত্র সদস্যদের দায়ী করে আসছে তারা। আর নিজেদের নেতা-কর্মী খুন ও অপহরণের জন্য আওয়ামী লীগ জেএসএসকে দায়ী করছে।

জানতে চাইলে জেএসএসের বান্দরবান জেলা সভাপতি উছোমং মারমা বলেন, ‘আমাদের সশস্ত্র ক্যাডার নেই। মগ পার্টি নামধারী দলছুট আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) সশস্ত্র সদস্যদের ভয়ে দুই মাস আগে থেকে আমাদের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে রয়েছেন।’

গত বৃহস্পতিবার রাজবিলা ইউনিয়নের তাইংখালী এলাকার ৭ নম্বর, কুহালং ইউনিয়নের ৩ নম্বর রাবারবাগান ও উজিমুখ হেডম্যানপাড়ায় সরেজমিনে দেখা যায় মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক। বাইরের লোক দেখলেই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ছেন বাসিন্দারা। বাড়িঘরে বৃদ্ধ, নারী ও শিশু ছাড়া যুবক ও মধ্যবয়সী পুরুষ দেখা যায়নি।

জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ৭ নম্বর রাবার বাগানপাড়ার একটি ছোট্ট দোকানে কয়েকজনকে পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করে তাঁরা বলেন, রাতে তাঁরা কেউ বাড়িতে থাকার সাহস পান না। ৭ ও ৮ নম্বর বাগানপাড়ার ৭০টি মারমা পরিবারের নারী-শিশুরা
ভয়ে একসঙ্গে এক বাড়িতে রাত কাটান। এই দুই ইউনিয়নে জেএসএসের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকও রয়েছে।

সূত্র জানায়, ১৮ মে রাতে ৮ নম্বর রাবার বাগানপাড়ার আওয়ামী লীগের এক নেতার ভাই ক্যচিংথোয়াই মারমাকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। এর ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রাতে আওয়ামী লীগের বান্দরবান পৌর শাখার সহসভাপতি চথুইমংকে অপহরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের জেলা সহসভাপতি ও বান্দরবান সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসের রাজনীতি করে না। এলাকায় তৎপর কয়েকটি সন্ত্রাসী দলই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। চথুইমং মারমাকে কারা অপহরণ করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানে কারা এসব কাজ করছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার এক মানববন্ধনে আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর এ হত্যাকাণ্ড এবং অপহরণের জন্য জেএসএসকে দায়ী করেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জেএসএসের জেলা সভাপতি উছোমং মারমা বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জেএসএসের সম্পর্ক নষ্ট করে ফায়দা লোটার জন্য তৃতীয় একটি পক্ষ এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেল জাতীয় নির্বাচনের সময় মগ পার্টির আবির্ভাব ঘটে। মগ পার্টিতে কিছু স্থানীয় মারমা যুবক ও বহিরাগত দলছুট আরাকান লিবারেশন পার্টির সদস্য রয়েছে। মগ পার্টি হঠাৎ করে এসে জেএসএসের নেতা-কর্মীদের কাজে বাধা দেওয়া শুরু করে। এ অবস্থায় রাঙামাটির রাজস্থলীতে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে জেএসএসের ক্যাডারদের সঙ্গে মগ পার্টির একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার জের ধরে পাল্টাপাল্টি হত্যা ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে। কুহালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সানুপ্রু মারমা বলেন, কুহালং ও রাজবিলা ইউনিয়নের সবাই দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তাইংখালী ৮ নম্বর রাবারবাগানে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অস্থায়ী চৌকি করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এ ব্যাপারে বান্দরবানের পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, হত্যা-অপহরণ বন্ধ ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রাবারবাগানে সেনা-পুলিশের একটি অস্থায়ী যৌথ চৌকি করা হবে।