বাসচাপায় ছাত্র নিহত, পুড়ল ৩৫ বাস

দুপুর ১২টা। কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহগামী শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে সারিবদ্ধভাবে বের হচ্ছিল কিছু বাস। প্রধান ফটকের কাছে একটি বাসের ভেতর থেকে তৌহিদুর রহমান (টিটু) নামের এক ছাত্র বাইরে মুখ বের করে বাসে ওঠার জন্য ডাকছিলেন এক সহপাঠীকে। হঠাৎই পাশ দিয়ে দ্রুত অতিক্রম করে যায় আরেকটি বাস। ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়ে চাকায় পিষ্ট হন তৌহিদুর। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। 
চোখের সামনে দেখা এমন দৃশ্যের বর্ণনা দিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নজরুল ইসলাম। ঘটনায় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা পরে পুড়িয়ে দেন ৩৫টি বাস। ভাঙচুর করেন আরও আট-দশটি।
শিক্ষার্থীদের ভাঙচুর থেকে বাদ পড়েনি উপাচার্যের বাসভবন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনও। পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশের। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ২৯ জন। সহিংসতার জেরে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়।
গতকাল রোববার দুপুর ১২টা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এমন তাণ্ডব চললেও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেননি। সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে বাসগুলোতে আগুন জ্বলছিল।
নিহত ছাত্র তৌহিদুর রহমান বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বিকেল চারটার দিকে নিজ বিভাগীয় শিক্ষক ও সহপাঠীরা লাশ নিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানান, দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা বাসগুলো শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ছিল। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে পেছন থেকে একটি বাস দ্রুত গতিতে সামনের বাসটিকে অতিক্রম করে। এতে বাসের ধাক্কায় তৌহিদুর মাটিতে পড়ে যান। এরপর বাসের একটি চাকা তাঁর মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা ৩৩টি ও নিজস্ব দুটি বাসে প্রথমে ভাঙচুর চালান। পরে সেগুলোতে আগুনে ধরিয়ে দেন। এর মধ্যে ক্যাম্পাসের একটি কোনায় বাসের ডিপোতে পোড়ানো হয় ২১টি বাস।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে এতগুলো বাসে আগুন ও ভাঙচুর চালানো হলেও ফায়ার সার্ভিসের কোনো গাড়িকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ভাঙচুর করেন। উপাচার্যের বাসভবনের মূল ফটকের ভেতর ঢুকেও ভাঙচুর করেন তাঁরা।
উপাচার্যের বাসভবনের নিরাপত্তাকর্মী উকিল বিশ্বাস বলেন, কয়েক শ ছাত্র হাতে লাঠিসোঁটা দিয়ে প্রধান ফটকে আঘাত করতে থাকেন। তাঁরা সেটা ভাঙতে না পেরে পাশেই নিরাপত্তাকর্মীদের কক্ষের জানালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে সেখানে ভাঙচুর চালান।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ: প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ছাত্র নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ওই সহিংসতা চালানোর পাশাপাশি ক্যাম্পাসে একটি মিছিল বের করেন। বিভিন্ন সড়ক ঘুরে প্রশাসন ভবনের সামনে গিয়ে তাঁরা সেখানে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। এ সময় দুই পক্ষে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করে ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। বেশ কিছু ফাঁকা গুলিও ছোড়ে পুলিশ।
সংঘর্ষে পুলিশের সাত সদস্য ও অন্তত ২২ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র এবং তাঁদের কেউ কেউ পরে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) প্রলয় চিসিম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশে এবং অনেকটাই আত্মরক্ষার্থে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। তবে রাবার বুলেট ছোড়া হয়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা: বিকেলে এক জরুরি সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের আজ সোমবার সকাল ১০টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ছাত্রীরা এ নির্দেশের প্রতিবাদে সন্ধ্যায় প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন।
উপাচার্য আবদুল হাকিম সরকার বলেন, ‘বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।’
সহিংসতা নিয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য: বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন প্রশাসক মামুনুর রহমান বলেন, বাস পোড়ানো হয়েছে মোট ৩৫টি। এগুলোর মধ্যে ৩৩টি ভাড়া করা। ভাঙচুর করা হয়েছে আরও আট-দশটি ছোট-বড় গাড়ি। এর মধ্যে উপাচার্যের গাড়িও রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য শাহিনুর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত ছিল। তবে অরক্ষিত ক্যাম্পাসে বহিরাগত ও ক্যাম্পাসের কয়েকজন শিক্ষকের ইন্ধনে তা ঘোলাটে হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে।’
সহ-উপাচার্য আরও বলেন, সহিংসতার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চালকদের প্রতি অভিযোগ: শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন, ভাড়া করা বাসচালকেরা তাড়াহুড়ো করে ক্যাম্পাস থেকে একে অপরকে অতিক্রম করে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ যাওয়ার চেষ্টা চালান। এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের রেখে আবার ক্যাম্পাসে ফেরার পথে চালকেরা বাসে সাধারণ যাত্রীদের তুলে টাকা আদায় করেন। যে চালকেরা আগে ক্যাম্পাস ছাড়েন, তাঁদের লাভ বেশি হয়। এমন প্রতিযোগিতায় অনেক ছাত্র বাধ্য হয়ে দৌড়ে বাসে ওঠেন।
কুষ্টিয়ায় পরিবহন ধর্মঘট: কুষ্টিয়া বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি সাধারণ সম্পাদক মকবুল হোসেন বলেন, পোড়ানো বাসের ক্ষতিপূরণ না পাওয়া পর্যন্ত কুষ্টিয়ায় আজ সকাল থেকে সব রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট চলবে।
এ ঘোষণার আগে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।