ডাকাতির নেপথ্যে বিশ্বস্ত কর্মচারী

ঢাকার তাঁতীবাজারের সোনালি গোল্ড হাউস থেকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকার অলংকার নিয়ে রাজবাড়ীর পলাশ জুয়েলার্সের দিকে রওনা দিয়েছিলেন অর্জুন হালদার। সঙ্গে বিশ্বস্ত ও পুরোনো কর্মচারী সুরেশ হালদার। হঠাৎ সাভারের আমিনবাজারের কাছে তাঁদের বাসের গতি রোধ করে দাঁড়ায় চারটি মোটরসাইকেল। নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে মারধর করে কেড়ে নেন সঙ্গে থাকা সব।

ডাকাতির ঘটনাটি গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বরের। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) শনাক্ত করে ডাকাত দলের সদস্যদের। প্রথম দফায় গ্রেপ্তার হন চারজন। ২৬ জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিক অভিযানে বাকি চারজন গ্রেপ্তার হন। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, বিশ্বস্ত ও পুরোনো সেই কর্মচারী সুরেশ হালদারই সোনা নিয়ে ঢাকা থেকে রাজবাড়ী যাওয়ার খবর পাচার করেছিলেন ডাকাত দলের কাছে। দলটি ২০১৮ সাল থেকে ডাকাতি করে আসছে। দলের অন্যতম সদস্য সাবেক সেনাসদস্য ফারুক হোসেন (৪০)।

পিবিআইয়ের ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম বলেন, দলটি সুসংগঠিত। তাদের ইন্টেলিজেন্স শাখা (গোয়েন্দা তথ্য), অপারেশন শাখা (ডাকাতি) ও সোনা কেনাবেচার কাজে যুক্ত একটি শাখা রয়েছে।

উত্তরায় পিবিআইয়ের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে আজ রোববার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খোরশেদ আলম বলেন, গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর তাঁতীবাজার থেকে অর্জুন হালদার তাঁর কারিগর সুরেশ হালদারকে নিয়ে রাজবাড়ী যাচ্ছিলেন। পলাশ জুয়েলার্সের মালিক গৌরাঙ্গ ও রাজলক্ষ্মী জুয়েলার্সের মালিক জয়দেবকে তাঁদের সোনার চেইন, কানের দুল, বল চেইন, কানপাশাসহ মোট ১৬৬ দশমিক ৫৫৩ ভরি স্বর্ণালংকার পৌঁছানোর কথা ছিল। অর্জুন হালদারের বাসার সামনেই সুরেশ হালদার অপেক্ষা করছিলেন। একসঙ্গে দুজন পায়ে হেঁটে তাঁতীবাজার মোড়ে আসেন। সেখান থেকে সাভার পরিবহন বাসে উঠে যান গাবতলী। তারপর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে আরেকটি বাসে উঠে রাজবাড়ীর দিকে রওনা দেন।

পুলিশ জানায়, সকাল সাড়ে আটটার দিকে সাভারের আমিনবাজার পার হওয়ার পর অল্প দূরে একটি বৈদ্যুতিক পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে। জায়গাটা ফাঁকা। সেখানে পৌঁছানোর পর চারটি মোটরসাইকেলে ১০-১২ জন মাস্ক পরা ডাকাত বাসের গতি রোধ করেন। তাঁদের কেউ কেউ বাসে ওঠেন ও নিজেদের পুলিশ পরিচয় দেন। তারপর স্বর্ণ ব্যবসায়ী অর্জুন হালদার ও তাঁর সঙ্গে থাকা সুরেশ হালদারকে টেনেহিঁচড়ে বাস থেকে নামান।

পৃথক মোটরসাইকেলে উঠিয়ে তাঁদের নিয়ে ডাকাত দল আবার গাবতলীর দিকে রওনা হয়। প্রায় ২০০ গজ যাওয়ার পর ডাকাত দল অর্জুন হালদারকে নাকে–মুখে কিলঘুষি মেরে রক্তাক্ত জখম করে। তারপর তাঁদের হাতে থাকা সোনাসহ ব্যাগটি এবং নকিয়া মুঠোফোন নিয়ে দ্রুতবেগে গাবতলীর দিকে মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যায়।

এ ঘটনায় অর্জুন হালদার গত ১৮ নভেম্বর ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে একটি মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে পিবিআই তদন্ত শুরু করে। তাদের কাছ থেকে ডাকাতির ২২ ভরি সোনা, সোনা বিক্রির পাঁচ লাখ টাকা, লুণ্ঠিত মুঠোফোন এবং ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। আদালতে তাঁরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আসামি সুরেশ হালদার জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, সংঘবদ্ধ আন্তজেলা স্বর্ণ ডাকাত দলের একজন সদস্য তিনি। সোনা বিক্রির জন্য রাজবাড়ী যাওয়ার তথ্য তিনিই ডাকাতদের জানিয়েছিলেন। ওই দিন ভোর থেকে মোটরসাইকেলে থাকা ডাকাত দল তাঁতীবাজারে অর্জুন হালদারের বাসার সামনে অপেক্ষা করছিল। তাঁদের পেছন পেছন ডাকাত দলও এগোতে থাকে। সুবিধাজনক সময়ে গাড়ি থামিয়ে কেড়ে নেয় সব।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন সুরেশ চন্দ্র হালদার (৪৮), মিঠুন মজুমদার ওরফে মিঠু (৩৩), উজ্জ্বল চন্দ্র দাস (৩২), মিহির দাস (৩২), মো. সোহেল আহম্মেদ পল্লব (৪৫), সাবেক সেনা সদস্য ফারুক হোসেন (৪০), শংকর চন্দ্র ঘোষ (৪৫) ও মিঠুন চৌকিদার (৩০)।
ডাকাতদের দেওয়া তথ্যমতে, আসামি শংকরের তাঁতীবাজারের সোনার দোকান থেকে বাদীর লুণ্ঠিত স্বর্ণালংকারের মধ্যে ২২ ভরি সোনা, আসামি মো. সোহেল আহম্মেদের বাসা থেকে লুণ্ঠিত সোনা বিক্রির পাঁচ লাখ টাকা, আসামি মিঠুন চৌকিদারের কাছ থেকে বাদীর লুণ্ঠিত মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়েছে এবং আসামি সাবেক সেনাসদস্য ফারুক হোসেনের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত হিরো হোন্ডা মোটরসাইকেল জব্দ করেছে পুলিশ।

তবে পুলিশ বলছে, আটজনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও ডাকাতির পরিকল্পনাকারীকে এখনো ধরা যায়নি। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।