বিস্ফোরক মামলার বিচার শেষ হয়নি

  • বিস্ফোরক আইনের মামলায় সাক্ষী ১ হাজার ৩৪৪ জন। এখন পর্যন্ত ২১০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।

  • হত্যা মামলায় হাইকোর্টে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে।

বিডিআর বিদ্রোহে ভারী অস্ত্র হাতে জওয়ানেরা
ফাইল ছবি

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একসঙ্গে দুটি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় বিচারিক আদালতের রায় হয়েছে। এই মামলা হাইকোর্টের রায়ের পর এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় বিচারিক আদালতে এখনো সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ হয়নি।

আরও পড়ুন

আজ থেকে ১৩ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ—বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ হয়। বিডিআরের কয়েক শ সদস্য বিদ্রোহের পর পিলখানায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালান। নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন পিলখানায় বিডিআরের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাঁদের অনেকের পরিবারের সদস্যরাও নৃশংসতার শিকার হন। দুই দিনব্যাপী ওই বিদ্রোহে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক মামলা হয়।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়েছিল। হত্যা মামলার বিচার চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে।

বিদ্রোহের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৮৫০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছিল। বিচারিক আদালতের রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি সবচেয়ে বড় মামলা।

হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ২০৬ জন আসামি পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছেন। এ ছাড়া আরও পাঁচ আসামির পক্ষে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে তিনটি লিভ টু আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবী। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া এবং সাজা কমা ৮৩ আসামির বিষয়ে ২০টি লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এখন এসব আপিল ও লিভ টু আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আপিলকারীপক্ষের সারসংক্ষেপ পেয়ে পর্যালোচনা করে একসঙ্গে আপিল ও লিভ টু আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আপিলের সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করে জমা দিতে ছয় মাস সময় লাগতে পারে। সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া ও প্রস্তুত হওয়া সাপেক্ষে আপিল ও লিভ টু আপিলের ওপর শুনানি হবে।

হাইকোর্টের রায়ে অপর্যাপ্ত সাজা ও খালাসের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে লিভ টু আপিল দায়ের করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামিপক্ষ গত বছর কয়েকটি আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করে। এই প্রক্রিয়ায় আপিলকারী (আসামিপক্ষ) পক্ষ সারসংক্ষেপ সরবরাহ করবে। সারসংক্ষেপ পেলে একসঙ্গে লিভ টু আপিল ও আপিলগুলো পর্যালোচনা করা হবে। এই প্রক্রিয়া আগামী মার্চ মাসের মধ্যেই শেষ করা হবে। এরপর শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন

মামলার পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে একাধিক আইনজীবী বলেছেন, আপিল দায়েরের পর সাধারণত সংক্ষুব্ধ পক্ষ অপর পক্ষকে আপিলের সারসংক্ষেপ সরবরাহ করে থাকে। লিভ টু আপিলের ক্ষেত্রে আদালতে শুনানি হয়ে থাকে। সংক্ষুব্ধ পক্ষের লিভ টু আপিল মঞ্জুর হলে নিয়মিত আপিল হিসেবে তা রূপান্তরিত হবে। এসব প্রক্রিয়া শেষে আপিলের ওপর শুনানি হবে।

হত্যা মামলা চূড়ান্ত ধাপে শুনানির অপেক্ষায়

বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে অনুমোদনের জন্য আসে। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। রায়ে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২২৮ জনকে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত ২৮৩ জন খালাস পেয়েছেন। হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৪২ জন আসামি মারা গেছেন।

রায় প্রকাশিত হওয়ার পর রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক লিভ টু আপিল করে। ২০২০ সালে ও গত বছর আসামিপক্ষ পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল করে।

এই মামলার কার্যক্রম সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ে অপর্যাপ্ত সাজা ও খালাসের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে লিভ টু আপিল দায়ের করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামিপক্ষ গত বছর কয়েকটি আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করে। এই প্রক্রিয়ায় আপিলকারী (আসামিপক্ষ) পক্ষ সারসংক্ষেপ সরবরাহ করবে। সারসংক্ষেপ পেলে একসঙ্গে লিভ টু আপিল ও আপিলগুলো পর্যালোচনা করা হবে। এই প্রক্রিয়া আগামী মার্চ মাসের মধ্যেই শেষ করা হবে। এরপর শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।

হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল সৈয়দ তৌহিদুল আলমসহ (তৎকালীন বিডিআরের ডিএডি) দণ্ডপ্রাপ্ত ৩৫০ জনের বেশি আসামির আইনজীবী ছিলেন মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুটি মামলা একই দিন হয়েছিল। অথচ হত্যা মামলাটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলেও বিস্ফোরক মামলা এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। দুটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি যাতে হয়, এটিই তাঁদের প্রত্যাশা।

সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে বিস্ফোরক মামলা

বিস্ফোরক আইনে করা মামলার বিচার ১৩ বছরেও শেষ হয়নি। এ মামলায় ১ হাজার ৩৪৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ কার্যদিবসে ২১০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ৯ ও ১০ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে। বিচারকাজ চলছে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে। এ মামলায় আসামি ৮৩৪ জন। তাঁদের মধ্যে ৪০ আসামি ইতিমধ্যে মারা গেছেন। অপর ১৯ আসামি এখনো পলাতক। বাকি ৭৭৫ আসামি কারাগারে আছেন।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে মামলাটির বিচারকাজ কিছুটা স্থবির ছিল। এখন স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম চলছে। প্রতি মাসে দুই দিন করে শুনানি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২১০ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। চলতি বছর মামলাটির কার্যক্রম শেষ হবে বলে আশা করেন তিনি।

বিস্ফোরক আইনের মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি চান আসামিদের স্বজনেরাও। এক আসামির বড় ভাই কামরুল হাসান বলেন, তাঁর ভাই তৎকালীন বিডিআরের সিপাহি আতিকুর রহমান। বিদ্রোহের ঘটনায় করা দুই মামলাতেই আতিকুর আসামি হলেও হত্যা মামলায় ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন। এই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হলে নিরপরাধ কেউ থাকলে সে-ও মুক্তি পাবে। তাই মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।

তবে বিস্ফোরক মামলার নিষ্পত্তি কবে হবে, তা অনিশ্চিত বলে মন্তব্য করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে ২৭৮ জন খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় তাঁরা আসামি থাকায় কেউ বের হতে পারেননি।

বিদ্রোহের বিচার

বিদ্রোহের ঘটনায় বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আইনে, যা সামারি ট্রায়াল (সংক্ষিপ্ত বিচার) নামে পরিচিত। তাতে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অন্যরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগ দেন। এ ছাড়া সারা দেশে বিশেষ আদালত গঠন করে বিচার করা হয়। বিশেষ আদালতে ৫৭টি মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জন জওয়ানের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। বিচার চলার সময় মারা গেছেন ৫ জন।