ব্রুনেইয়ে পর্যটক ভিসায় শ্রমিক পাঠাত ‘হিমু চক্র’

মেহেদী ও হিমু চক্রের ২৪ জনের নাম পেয়েছে পুলিশ। তবে মেহেদী এখনো ধরা পড়েননি।

ব্রুনেইয়ে নিজের বিলাসবহুল গাড়ির সামনে মানব পাচারের হোতা মেহেদি হাসান।
ছবি: সিআইডি

সংসারের হাল ধরতে তিন লাখ টাকা খরচ করে ব্রুনেই গিয়েছিলেন পিরোজপুরের নাজিরপুরের যুবক মনির হোসেন (৩৫)। দেশটিতে পৌঁছানোর পর বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই বুঝতে পারেন, তিনি আসলে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাঁকে ব্রুনেই নেওয়া হয়েছে পর্যটক ভিসায়।

ঘটনা গত বছরের নভেম্বরের। এরপর দুই মাস পালিয়ে থাকা, অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটানো, পুলিশের হাতে ধরা পড়া ও নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরার করুণ কাহিনি। ব্রুনেইয়ে পুলিশের মারধরে কোমর ও বুকে মারাত্মক আঘাত পেয়েছিলেন মনির। এখন চলাফেরাও করতে পারেন না।

কাজের খোঁজে বিদেশে যেতে গিয়ে দেশের যে তরুণেরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, তাঁদের তালিকায় মনির হোসেন নতুন একটি নাম। তিনিসহ মোট ৯ জন ২৭ লাখ টাকা দিয়েছিলেন শেখ আমিনুর রহমান ওরফে হিমু (৫৫) নামের এক ব্যক্তিকে। হিমু নিজেকে বড় শিল্পপতি পরিচয় দিয়ে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও চেয়েছিলেন। এখন অবশ্য ধরা পড়ে কারাগারে রয়েছেন।

হিমু ও তাঁর দুই সহযোগীকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার মহাখালীর ডিওএইচএস থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। হিমুর বিরুদ্ধে মানব পাচার ও প্রতারণার অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে। অবশ্য চক্রের প্রধান মেহেদী হাসানসহ বাকি সদস্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। পুলিশ ও র‌্যাব জানিয়েছে, এ চক্রের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৪ জন। তাঁরা গত বছর অন্তত ৪০০ জনকে ব্রুনেইয়ে পাঠানোর কথা বলে ৩৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। যদিও ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে কর্মসংস্থান এবং তিন মাসের পর্যটক ভিসায় মাত্র ৬০ জনকে তাঁরা ব্রুনেই পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে কাউকে সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে। আবার কারও পর্যটক ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মানবেতর দিন কাটিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে।

পিরোজপুরের মনির হোসেন হিমুর খোঁজ পেয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধুর মাধ্যমে। হিমু তাঁকে ব্রুনেইয়ে একটি তেল কোম্পানিতে মাসিক ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তিন লাখ টাকা চান। মনির প্রথম আলোকে বলেন, হিমুর কথা বিশ্বাস করে তাঁরা নয়জন মোট ২৭ লাখ টাকা দেন। সবাইকে গত নভেম্বরে ব্রুনেইয়ে পাঠানো হয়।

পৌঁছানোর পর রিফাত হোসেন নামে চক্রের এক সদস্য তাঁদের কাছ থেকে কৌশলে পাসপোর্ট নিয়ে কেটে পড়েন। মনির বলেন, ‘আমরা মেহেদী-হিমুদের তেল কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। পাসপোর্ট না থাকায় আমরা পুলিশের ভয়ে ব্রুনেইয়ের একটি জঙ্গলে একটি ভাঙাচোরা বাড়িতে আশ্রয় নিই। সেখানে আরও ৩৫-৩৬ জন বাংলাদেশি ছিলেন। তাঁরাও প্রতারিত হয়েছিলেন।’

হিমুর হাতে প্রতারণার শিকার হওয়া আরেক ব্যক্তি রাজধানীর উত্তরখানের বাসিন্দা আবদুল লতিফ প্রামাণিক। তিনি জানান, তাঁর মতো ৬৫ জনের কাছ থেকে ভিসা প্রক্রিয়াকরণের কথা বলে ৪৫ লাখ টাকা নিয়েছিলেন হিমু।

হিমুর বিরুদ্ধে করা প্রতারণা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাফরুল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রিমান্ডে হিমু লোক পাঠানোর পর ব্রুনেইয়ে তাঁদের কাছ থেকে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

হিমু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মেহেদী হাসানের কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডিকে বলেছেন, ব্রুনেইয়ে মেহেদী বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। তিনি সেখানে গুলিরোধী (বুলেটপ্রুফ) ‘হামার এইচ-২’ মডেলের গাড়ি চালাতেন। তাঁর বাড়ি মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার যাতারপুরে। ৯ বছর আগে তিনি শ্রমিক ভিসায় ব্রুনেইয়ে গিয়েছিলেন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ জানিয়েছে, মেহেদী হাসানের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনার গত ৩ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠান। সেটি সিআইডিকে দেওয়া হয়। পরে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মেহেদীর কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, প্রতারণার অভিযোগে ব্রুনেই সরকার মেহেদীসহ চক্রের সাতজনকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর আগে মেহেদী পাঁচ সহযোগীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। এখন তিনি দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাবুল ও তাঁর কয়েকজন আত্মীয় মিলে মেহেদী-হিমু চক্রকে ২৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। বাবুল বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরেকটু সক্রিয় হলেই মেহেদীকে গ্রেপ্তার করতে পারে।