‘বড় শিল্পপতি’ যখন মানব পাচারকারী

আমিনুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ব্রুনেইয়ে মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া শেখ আমিনুর রহমান ওরফে হিমু গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে তিনি নড়াইল-২ (লোহাগড়া উপজেলা ও নড়াইল সদরের একাংশ) আসন থেকে দলীয় মনোনয়নও চেয়েছিলেন। তবে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করার আগে এলাকায় তাঁর তেমন পরিচিতি ছিল না।
ভোটের প্রায় এক বছর আগে এলাকায় হিমুর যাতায়াত বাড়ে। স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও তখন নির্বাচনী এলাকায় নিজের ছবিসহ রঙিন পোস্টার ও ব্যানার ছাপিয়ে তিনি আলোচনায় আসেন। তবে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় ভোটের পর এলাকায় আর তাঁর কোনো কার্যক্রম ছিল না। গত বুধবার বিকেলে র্যাবের অভিযানে ধরা পড়ার পর আবার তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ভোটের আগে লোহাগড়ার রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের কাছে নিজেকে বড় ‘শিল্পপতি’ হিসেবে পরিচয় দিলেও এখন মানব পাচারে তাঁর নাম আসায় অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

তবে দলীয় মনোনয়ন না পেলেও বিভিন্ন জায়গায় হিমু নিজেকে সাংসদ হিসেবে পরিচয় দিতেন বলে গত বুধবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে র্যাব।
লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুন্সী আলাউদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, হিমু আওয়ামী লীগের কেউ নন। তাঁর কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কেউ তাঁর সঙ্গে ছিল না। টাকা ছড়িয়ে কিছু লোককে সঙ্গে নিয়ে তখন তিনি এলাকায় ঘুরতেন। ভোটের আগে তিনি কীভাবে দলের নামে পোস্টার–ব্যানার ছাপালেন, তা তখনই চ্যালেঞ্জ করা উচিত ছিল।
হিমুর বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ঈশানগাতি গ্রামে। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁর বাবা কৃষক ছিলেন। ৬০ বছর আগে জমিজমা বিক্রি করে পরিবারটি খুলনার দৌলতপুরে চলে যায়। একসময় খুলনা থেকে পরিবারটি ঢাকায় চলে যায়। তরুণ বয়সে হিমু কয়েক বছর ইতালি ছিলেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগের বছর তিনি এলাকায় আসেন। এর আগে তাঁদের পরিবারের কেউ লোহাগড়ায় আসেননি।

লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনে তিনি আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করেন। তিনি নিজেকে ‘সুরাইয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। সবাইকে বলতেন, তাঁর আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা আছে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু এ আসনে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনি আর এলাকায় ফেরেননি।

গত সংসদ নির্বাচনে নড়াইল–২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন মানব পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া শেখ আমিনুর রহমান ওরফে হিমু।

এদিকে গতকাল হিমুর বিরুদ্ধে মানব পাচার ও প্রতারণার অভিযোগে কাফরুল থানায় দুটি পৃথক মামলা করেছে র‍্যাব। দুই মামলায় হিমুসহ মামলার অপর দুই আসামিকে চার দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচারের চক্রে আর কারা আছে এবং প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে জানতে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ চক্রের মূল হোতা মেহেদী হাসান ওরফে বিজনসহ অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
ব্রুনেইয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে ৬০ জনের কাছ থেকে হিমু মোট তিন কোটি টাকা নিয়েছেন বলে র্যাব জানিয়েছে। এ বিষয়ে র‍্যাব-৩–এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বীণা রানি দাস গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মেহেদী ও হিমু ব্রুনেইয়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। তাঁদের প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা র্যাবের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। অনুসন্ধান করে ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পর তাঁদের ধরতে অন্তত ১৫ বার অভিযান চালানো হয়। ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করায় হিমুকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার ছয়টি মামলার তথ্য জানা গেছে।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, মেহেদী ব্রুনেইয়ে অবস্থান করতেন। মানব পাচার করে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। ঢাকায় তাঁর বিরুদ্ধে মানব পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৯টি মামলা রয়েছে। তাঁর এক সহযোগী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ব্রুনেইয়ে ধর্ষণের মামলা আছে। মেহেদী, আবদুল্লাহ, নুর আলম, বাবলু রহমান ও হিমু মিলে ব্রুনেইকেন্দ্রিক একটি মানব পাচার চক্র গড়ে তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে হিমু, বাবলু ও নুর ধরা পড়েছেন। এ চক্র ৪৬০ জনকে ব্রুনেই পাঠানোর কথা বলে ৩৩ কোটি হাতিয়ে নেয়। তাঁদের মধ্যে ৬০ জন ব্রুনেই যেতে পারলেও সেখানে তাঁদের কোনো কাজ জোটেনি। ব্রুনেইয়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কাজের জন্য ভিসা সংগ্রহ করত চক্রটি।