সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে খুকনি ও জালালপুর ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ এনায়েতপুর-হাটপাচিল সড়কের পাশে কয়েক কিলোমিটার অংশের জলাশয় ও খাল থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নে করতোয়া নদী থেকেও।
বালু তোলার কারণে খুকনি ও জালালপুরে ভাঙনের মুখে পড়ছে সড়ক এবং এর পার্শ্ববর্তী ফসলি জমি ও বাড়িঘর। আর নদী থেকে বালু তোলায় এরই মধ্যে বিলীন হয়েছে হাবিবুল্লাহ নগরের বহু ফসলি জমি ও বাড়িঘর। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিয়ে এবং মিছিল, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী ও উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এনায়েতপুর-হাটপাচিল সড়কের সোনাতলা ও দ্বাদশপট্টি এলাকায় সড়কের দুই পাশের তিন কিলোমিটার অংশের জলাশয়, খাল ও বরোপিটে (খোলা জায়গা) সারা বছরই কমবেশি পানি থাকে। চার মাস ধরে এসব স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দেশীয় খননযন্ত্র বসিয়ে খুকনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফাজ উদ্দিন ব্যাপারী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গোঞ্জের আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দলের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী এই বালু তুলছেন। এতে সড়কের কিছু অংশ ছাড়াও আশপাশের জমিতে ভাঙন শুরু হয়েছে। হুমকিতে পড়েছে সেখানকার বাড়িঘরগুলোও।
সম্প্রতি সরেজমিেন দেখা যায়, সড়কটির দুই পাশেই খননযন্ত্র বসানো হয়েছে। যন্ত্রগুলো দিয়ে বালু তুলে সড়কের পাশে ভাড়া নেওয়া জায়গায় রাখা হচ্ছে। প্রতি ট্রাক বালু আট শ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ ট্রাক বালু বাইরে পাঠানো হচ্ছে বলে জানান এলাকাবাসী।
ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন বলেন, সড়কের পাশের এসব জায়গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীন। এ বোর্ডের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে এভাবে বালু তোলা হচ্ছে। বালু তোলায় অনেক ফসলি জমি ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়েছে। প্রতিকার চেয়ে দ্বাদশপট্টি গ্রামের পক্ষ থেকে দলপতি রেজাউল করিমসহ ৬১ জনের স্বাক্ষর-সংবলিত একটি লিখিত অভিযোগ সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর দাখিল করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ইউএনও শামীম আহমেদ বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর দ্রুত ব্যবস্থা নিতে এনায়েতপুর থানা-পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ও দ্বাদশপট্টি গ্রামের রেজাউল করিম বলেন, লিখিত অভিযোগের পর বালুদস্যুরা নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। আর খুকনি ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হলেও কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা আফাজ উদ্দিন ব্যাপারী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা গোঞ্জের আলী ভূঁইয়া দাবি করেন, সোনাতলা ফয়েজিয়া দাখিল মাদ্রাসার মাঠ ও কবরস্থান ভরাটের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনুমোদন নিয়েই বালু তোলা হচ্ছে।
তবে ওই মাদ্রাসার সুপার আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। যাঁরা বালু তুলছেন, বিষয়টি তাঁদের ব্যাপার। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এতে জড়িত নয়।’
জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
করতোয়া থেকে বালু উত্তোলন: হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নে করতোয়া নদী থেকেও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এটি বন্ধ করা ও বালুমহালের ইজারা বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন এখানকার এলাকাবাসীও। মৌন মিছিল করেছেন শত শত লোক। তাঁরা প্রশাসন বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। করেছেন প্রতিবাদ সভা ও সংবাদ সম্মেলন।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে করতোয়া নদীসংলগ্ন রতনকান্দি গ্রামের উত্তরপাড়ায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন গ্রামবাসী। সভায় ‘গ্রাম বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও’ আন্দোলনের সমন্বয়ক অরূপ গজনবী সভাপতিত্ব করেন।
সভায় বক্তারা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের লোকজন শাহজাদপুর সদর মৌজাসহ আশপাশের চারটি মৌজার অন্তর্ভুক্ত করতোয়া নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় ইউনিয়নের রতনকান্দি, নগরডালা, বাদলবাড়ি, দরগারচর, ফরিদপাঙ্গাসী, নারুয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের শত শত বিঘা ফসলি জমি, অর্ধশত বাড়িঘর, রাস্তা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
বক্তারা আরও বলেন, ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে নগরডালা উচ্চবিদ্যালয়, কুমিরগোয়ালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, করতোয়া সেতু, হজরত শাহ মখদুম (রহ.) ও হজরত শাহ হাবিবুল্লাহর (রহ.) মাজার ও মসজিদ। অবিলম্বে বালু উত্তোলন ও স্থানীয় বালুমহালের ইজারা বাতিল করা না হলে ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচির হুমকি দেন তাঁরা।
সভা শেষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অরূপ গজনবী। তিনি বলেন, প্রকৃত বালুমহাল না হওয়া সত্ত্বেও পাঁচ-ছয় বছর ধরে কর্তৃপক্ষ এ ইউনিয়নে বালুমহাল ইজারা দিয়ে আসছে। বালুমহালের অধিকাংশ জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি ও ফসলি জমি। শুষ্ক মৌসুমে গ্রামবাসী ওই স্থানে ইরি-বোরো আবাদ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ইজারাদার কে এম নাছিরউদ্দিন বালুমহালের কার্যাদেশের শর্ত ভেঙে চারটি খননযন্ত্র দিয়ে ইজারাবহির্ভূত এলাকা থেকে বালু তুলছেন। নাছিরউদ্দিন আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় তাঁর বাহিনী প্রতিনিয়ত এলাকাবাসীকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
তবে কে এম নাছিরউদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘বিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে বালুমহালের ইজারা নেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কোনো শর্ত ভঙ্গ করা হয়নি।’
অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও শামীম আহমেদ জানান, জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলন করছে। বালুমহালের এলাকা সার্ভেয়ার দিয়ে মেপে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। যদি এর বাইরে থেকে বালু তোলা হয়, তবে অবশ্যই বন্ধ করে দেওয়া হবে। তা ছাড়া যদি ভাঙন দেখা দেয়, তাহলেও বালু তোলা বন্ধ করা হবে।