ভারত হয়ে সিঙ্গাপুর যেতে চেয়েছিলেন সাহেদ করিম

সাহেদ করিম
সাহেদ করিম

রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম ভারত হয়ে সিঙ্গাপুরে পালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। র‌্যাবের দায়িত্বশীল একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, ৬ জুলাই উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পরদিন স্ত্রীকে ফোন করে এই পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

তবে এ বিষয়ে সাহেদের স্ত্রী সাদিয়া আরবীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ৬ জুলাইয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তাঁর আর কথা হয়নি। এখন প্রশ্ন উঠছে, র‌্যাব সাহেদের পাসপোর্ট জব্দ করার পরও তিনি কীভাবে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন?

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, একজন নাগরিকের একই দেশের দুটি পাসপোর্ট থাকার সুযোগ নেই।‌ তবে দুটি আলাদা দেশের পাসপোর্ট থাকতে পারে। সাহেদের বেলায় ঠিক কী ঘটেছে, তাৎক্ষণিকভাবে তিনি জানাতে পারেননি।

এদিকে র‌্যাব গতকাল শুক্রবার সাহেদের দুই সহযোগীকে আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা সাহেদকে পালানোয় সহযোগিতা করেছিলেন বলে জানা গেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন গিয়াসউদ্দিন জালাল (৬১) ও মো. মাহমুদুল হাসান (৪০)।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গিয়াসউদ্দিন রিজেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের ভায়রা। রিজেন্টে অভিযান হলে সাহেদ নরসিংদীতে পালিয়ে এই গিয়াসউদ্দিনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর দুজন মিলে মহেশখালীতে যান। যে গাড়িতে করে সাহেদ পালিয়েছিলেন, সেটি চালাচ্ছিলেন মাহমুদ।

এক প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, মহেশখালীতে সাহেদ করিম প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের ঠিকাদারি পেয়েছিলেন।‌ প্রায়ই সেখানে যেতেন। একই গাড়িতে করে তিনি মহেশখালী থেকে ঢাকায় ফেরেন। ঢাকা থেকে আরিচা পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃতরা সাহেদের সঙ্গে ছিলেন।

৬ জুলাই করোনার নমুনা সংগ্রহের পর ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়া ও সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে টাকা আদায়ের অভিযোগে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। পরদিন উত্তরা পশ্চিম থানায় সাহেদকে এক নম্বর আসামি করে ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ৯ দিন পর সাতক্ষীরা থেকে সাহেদকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

১৮ ধরনের জালিয়াতি

সাহেদ এখন ১০ দিনের রিমান্ডে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে আছেন। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত প্রাথমিক অনুসন্ধান, সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ১৮ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে সাহেদের যুক্ততার তথ্য তাঁরা পেয়েছেন।

একেকবার একেক পরিচয় দেওয়া, কখনো সেনা কর্মকর্তা, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, কখনো গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, আবার কখনো বড় ব্যবসায়ী ও দানবীর। নিজেকে ক্যানসার রোগী বলেও সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করেছেন মো. সাহেদ।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সাহেদ যে প্রতারক, সে তথ্য ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল একটি বাহিনী। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন মহলের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই তিনি প্রতারক হয়ে ওঠেন।

সূত্র বলছে, হাসপাতাল ব্যবসা থেকে সাহেদের আয় ছিল সামান্যই। তাঁর প্রধান ব্যবসা ছিল বিভিন্ন প্রকল্পে পাথর সরবরাহ। তিনি পদ্মা সেতু ও একটি বাহিনীর প্রকল্পে বাজারদরের চেয়েও কম দামে পাথর সরবরাহ করতেন।

সিলেট থেকে যে ব্যবসায়ীরা পাথর এনে দিতেন, তাঁদের কোনো টাকাপয়সা তিনি দিতেন না। তাই বাজারদরের চেয়ে কমে সরকারি প্রকল্পে সরবরাহের কাজ করছিলেন। এই কাজ করতে গিয়েও অনেকের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল সাহেদের। সাহেদ পুলিশের বদলির তদবির করতেন বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের বড় সব অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রণ পেতেন।

সরকারের কেনা দামি যন্ত্র রিজেন্টে

সাহেদকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারি হাসপাতালের জন্য কেনা দামি যন্ত্রপাতি বিনা মূল্যে সরবরাহ করেছিল। প্রায় কোটি টাকা মূল্যের ডায়ালাইসিস মেশিন, ভেন্টিলেটর, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও বেড সাহেদ পেয়েছিলেন রিজেন্ট হাসপাতালের জন্য। ১৩ জুলাই কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান যন্ত্রগুলো ফিরিয়ে আনতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন।

সরকারি হাসপাতালের জন্য কেনা যন্ত্রপাতি কী করে সাহেদ পেলেন, তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল) ইউনূস আলী বলেন, চুক্তিতে থাকলে রোগীদের স্বার্থে বেসরকারি হাসপাতালকে যন্ত্রপাতি দেওয়া যায়। তবে চুক্তি ঘেঁটে এমন কিছু পাওয়া যায়নি।

তথ্য আহ্বান

রিজেন্টে অভিযানের পর অনেকেই সাহেদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। পল্লবী থানায় ফিরোজ আলম চৌধুরী নামের একজন মামলা করেছেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আড়াই লাখ টাকা ভাড়ায় পল্লবীতে তিনি ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন হাসপাতাল করতে। চার বছর ধরে ভাড়া দেননি। এ অভিযোগে ফিরোজ মামলা করেন।

যাঁরা সাহেদ সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে চান তাঁদের তথ্য দিতে ও আইনি সহায়তার জন্য ০১৭৭৭৭২০২১১ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।