ভারতে জিম্মিদশায় তরুণীর ৭৫ দিন

পালিয়ে আসা এক তরুণী প্রথম আলোকে জানিয়েছেন তাঁকে ফাঁদে ফেলা ও নির্যাতনের কথা

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

টিকটকে ভিডিও বানানোর কথা বলে কৌশলে ভারতে পাচার, সেখানে দফায় দফায় নির্যাতন ও যৌনকর্মে বাধ্য করা—পালিয়ে আসা এক তরুণী জানালেন তাঁর ৭৫ দিনের জিম্মিদশার কথা।

এই তরুণী গত ৭ মে ভারত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। আর গত মঙ্গলবার ঢাকার হাতিরঝিল থানায় তিনি পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁকে পাচারের ঘটনায় জড়িত ছিলেন ‘টিকটক হৃদয়’ নামে পরিচিত রিফাদুল ইসলাম ওরফে হৃদয় (২৬)। ভারতে বাংলাদেশের এক তরুণীকে যৌন নির্যাতন করার ভিডিও সম্প্রতি ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে হৃদয়কে নির্যাতন করতে দেখা যায়। গত বৃহস্পতিবার হৃদয়সহ ছয়জনকে ভারতের বেঙ্গালুরুর পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

ভারত থেকে পালিয়ে আসা তরুণী গতকাল বুধবার হাতিরঝিল থানা ভবনে প্রথম আলোর কাছে তাঁকে জোর করে ভারতে নিয়ে যাওয়া, ৭৫ দিন আটকে রাখা ও নির্যাতনের ঘটনা জানান। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের মার্চে এক বান্ধবীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে। সে সময় হৃদয় তাঁর ফোন নম্বর নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করেছিলেন। তবে তিনি দেননি। এরপর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর একটি সুপরিচিত বিপণিবিতানে বিক্রয়কর্মীর চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গেলে সেখানে আবার হৃদয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সে সময় অনেক অনুরোধের পর তিনি হৃদয়কে নিজের মুঠোফোন নম্বরটি দিয়েছিলেন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হৃদয়ের অনুরোধে নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে ‘টিকটক হ্যাং আউট’ পার্টিতে যোগ দেন তরুণী। পরের মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তিনি যে বিপণিবিতানটিতে চাকরি করতেন, সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় হৃদয় তাঁকে টিকটকের মাধ্যমে আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলেন।

টিকটক ভিডিও বানানোর কথা বলে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তরুণীকে কুষ্টিয়ায় যাওয়ার জন্য বলেন হৃদয়। তবে তাঁকে নেওয়া হয় সাতক্ষীরায়। তরুণী বলেন, সেখানে রাত হয়ে যায়। তখন হৃদয় গাড়ি পাওয়া না যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে তাঁকে সাতক্ষীরাসীমান্তের একটি বাড়িতে রাখেন। পরদিন সকালে হৃদয়, মেহেদী হাসানসহ ছয় যুবক তাঁকে সীমান্তে টিকটক ভিডিও করতে যাওয়ার জন্য জোর করেন। এ সময় আরও পাঁচ তরুণী তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। রাস্তা ব্যবহার না করে খেত ধরে দুই ঘণ্টা হাঁটার পর চারটি মোটরসাইকেলসহ চার ব্যক্তিকে দেখতে পান। সেখান থেকে আরেকটি মেয়েসহ তাঁকে দুটি মোটরসাইকেলে উঠিয়ে কলকাতায় নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের একটি টিনশেড ঘরে রাখা হয়।

তরুণী প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তে নেওয়ার পর একপর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি পাচার চক্রের হাতে পড়েছেন। তখন তাঁর আর কিছুই করার ছিল না।

দুঃসহ নির্যাতন

ভারতে পাচারের সময় ওই তরুণীর সঙ্গে আরেকটি মেয়ে ছিলেন। তরুণী প্রথম আলোকে জানান, কলকাতায় নেওয়ার পর টিকটক হৃদয় ও বকুল নামের তাঁর এক সহযোগী তাঁদের দুজনকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করেন। সেগুলোর ভিডিও করা হয়। এরপর থেকে তাঁকে ভিডিও ফাঁস করে দেওয়া এবং অবৈধভাবে ভারতে এসেছেন বলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। পরে কলকাতা থেকে বিমানে করে তাঁদের দুজনকে বেঙ্গালুরুতে নেওয়া হয়। সেখানে সবুজ নামে চক্রের এক সদস্য তাঁদের গ্রহণ করেন। এরপর চক্রের আরেক সদস্য রুবেলের বাসায় নেওয়া হয় তাঁদের। সেখানে তাঁরা বাংলাদেশের আরও দুই তরুণীকে দেখতে পান। এঁদের একজনকে হায়দরাবাদে একটি হোটেলে পাঠানো হয়। তাঁকে চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে পাঠাতে চাইলে তিনি যেতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হৃদয়, তাঁর সহযোগী সাগর ও সবুজ তাঁকে নির্যাতন করেন। পরে তাঁকে জোর করে ১০ দিনের জন্য চেন্নাইয়ের হোটেলে পাঠানো হয়। সেখানে নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়লে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে টিকটক হৃদয়ের হাতে তুলে দেয়। পরে তাঁকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে আসা হয়।

তরুণী জানান, একসময় তিনি পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। গত ৫ মে চক্রের এক সদস্য তাঁকে বেঙ্গালুরুর একটি জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের আড়ালে গিয়ে কৌশলে পালিয়ে যান। সেখান থেকে ট্রেনে প্রথমে কলকাতা যান। পরে দালালের মাধ্যমে ৭ মে দেশে ফেরেন তিনি। গত সপ্তাহে বাংলাদেশের এক তরুণীকে ভারতে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তিনি পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন।

এই তরুণীর করা মামলার ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার রাতে সাতক্ষীরা থেকে বাবা-ছেলেসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে ছেলে মেহেদী হাসান (৩৫) গত আট বছরে এক হাজারের বেশি নারীকে ভারতে পাচার করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। এই চক্রের অপর চার সদস্যকে গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব বলেছিল, তারা পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক নারীকে ভারতের বেঙ্গালুরুতে পাচার করেছে।

ভারত থেকে পালিয়ে আসা তরুণী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চাই আর কোনো তরুণী এই চক্রের খপ্পরে না পড়ুক। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’

গ্রেপ্তার-রিমান্ড

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে মেহেদী হাসান, তাঁর বাবা আবদুল কাদের (৫৫) এবং মহিউদ্দিন (৩০) নামের তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর তাঁদের কাছ থেকে নারী পাচারের কাজে ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল, একটি ডায়েরি, চারটি মুঠোফোন ও একটি ভারতীয় সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।

এদিকে নারী পাচারে জড়িত অভিযোগে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়া আশরাফুল ইসলাম, সাহিদা বেগম, ইসমাইল সরদার ও আবদুর রহমান শেখকে গতকাল রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. হাফিজ আল ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ভারতে পাচার চক্রের হাত থেকে পালিয়ে আরও তিন তরুণী দেশে এসেছেন। তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।