ভুয়া পরোয়ানা: হাইকোর্টের ৭ দফা নির্দেশনা

হাইকোর্ট ভবন
ফাইল ছবি

গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির অনুসারে নির্ধারিত ফরমে সঠিক ও সুস্পষ্টভাবে তথ্যাদি পূরণসহ ‘ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা’ রোধে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার সাত দফা নির্দেশনা–সংবলিত আদেশ দেন।

আদালত বলেছেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর নাম (অফিস স্টাফ), পদবি, মোবাইল ফোন নম্বরসহ সিল, তাঁর সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর ব্যবহার করতে হবে। যাতে পরোয়ানা কার্যকর করা ব্যক্তির পরোয়ানার সঠিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ হলে পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে এর সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।

প্রথম নির্দেশনার চতুর্থ দফায় এসব উল্লেখ রয়েছে। নির্দেশনাটির শুরুতে বলা হয়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যুর সময় পরোয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৭৫ ধারার বিধান অনুসারে নির্ধারিত ফরম চাহিদা অনুযায়ী সঠিক ও সুস্পষ্টভাবে তথ্য দিয়ে পূরণ করতে হবে। যেমন: ক. যে ব্যক্তি বা যেসব ব্যক্তি পরোয়ানা কার্যকর করবেন, তাঁর বা তাঁদের নাম, পদবি ও ঠিকানা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। খ. যাঁর প্রতি পরোয়ানা ইস্যু করা হচ্ছে, অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা, এজাহার বা নালিশি মামলা কিংবা অভিযোগপত্রে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট মামলার নম্বর ও ধারা এবং ক্ষেত্রমতে আদালতের মামলার নম্বর ও ধারা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। গ. সংশ্লিষ্ট জজ (বিচারক) /ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরের নিচে নাম ও পদবির সিল এবং ক্ষেত্রমতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকের নাম, পদবির সিলসহ বাঁ পাশে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট আদালতের সুস্পষ্ট সিল ব্যবহার করতে হবে।

‘ভুয়া পরোয়ানার চক্করে আওলাদ, হাইকোর্টে স্ত্রী’ শিরোনামে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর আগে আওলাদকে বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়নি, তা নিশ্চিতে তাঁকে হাইকোর্টে হাজির করতে নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রিট করেন তাঁর স্ত্রী শাহনাজ পারভীন। এতে বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কক্সবাজারের এক মামলায় পরোয়ানা দেখিয়ে গত বছরের ৩০ অক্টোবর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার আওলাদ হোসেনকে আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আওলাদের স্ত্রীর করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ কয়েক দফা নির্দেশ দেন। অন্য কোনো মামলায় আওলাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা বা হাজিরা পরোয়ানা থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই সাপেক্ষে তাঁকে মুক্তি দিতেও বলা হয়। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি আওলাদ মুক্তি পান। এর মধ্যে সিআইডি ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সঙ্গে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় আটজনের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় একটি মামলাও হয়। এই মামলার আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিসহ গত ৯ মার্চ সিআইডি উচ্চ আদালতে একটি প্রতিবেদন দেয়। অন্যদিকে ওই ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে সম্পূরক আবেদন করেন আওলাদের স্ত্রী। আজ বিষয়টি আদেশের জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে। হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা আবেদনটি যথাযথ আদালতে উপস্থাপন করতে বলে ওই নির্দেশনাসহ আদেশ দেন।

আদালতে আওলাদের স্ত্রীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এমাদুল হক বসির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন। পরে আইনজীবী এমাদুল হক বসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুয়া পরোয়ানা রোধে হাইকোর্ট সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা আবেদনটি এখতিয়ারভুক্ত হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করতে বলেছেন। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে পরোয়ানার নিচে শুধু সিল থাকত। হাইকোর্টের আদেশের ফলে এখন পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর সিল, পদবি ও ফোন নম্বর উল্লেখ করতে হবে। এসব নির্দেশনা ভুয়া পরোয়ানা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’

আরও পড়ুন

হাইকোর্টের অন্য নির্দেশনা

দ্বিতীয় নির্দেশনায় বলা হয়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুত করা হলে স্থানীয় অধিক্ষেত্র কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট পিয়ন বহিতে তা এন্ট্রি করে বার্তাবাহকের মাধ্যমে পুলিশ সুপারের কার্যালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠাতে হবে। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের বা থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পিয়ন বহিতে স্বাক্ষর করে তা বুঝে নিতে হবে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রেরণ ও কার্যকর করার জন্য পর্যায়ক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কাজে লাগানো যেতে পারে।

তৃতীয় নির্দেশনায় বলা হয়, স্থানীয় অধিক্ষেত্রের বাইরের জেলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার ক্ষেত্রে পরোয়ানা ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সিলগালা করে এবং অফিসের সিলমোহরের ছাপ দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠাবে।

চতুর্থ নির্দেশনার ভাষ্য, সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিলমোহর করা খাম খুলে প্রাপ্ত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পরীক্ষা করে এর সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ব্যবস্থা নেবেন। তবে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ক্ষেত্রে সন্দেহের উদ্রেক হলে পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে এর সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।

পঞ্চম নির্দেশনায় বলা হয়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা গ্রহণকারী কর্মকর্তা পরোয়ানা পেয়ে তা কার্যকরের আগে পুনরায় পরীক্ষা করে যদি কোনোরূপ সন্দেহ পোষণ করেন, সে ক্ষেত্রে পরোয়ানায় উল্লেখ করা পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে এর সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে পরোয়ানা কার্যকর করবেন।

ষষ্ঠ নির্দেশনা অনুসারে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুসারে আসামি বা আসামিদের গ্রেপ্তারের পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আসামিকে নিকটস্থ আদালতে পরোয়ানাসহ হাজির করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ গ্রেপ্তার করা আসামি বা আসামিদের জামিন প্রদান না করলে আদেশের অনুলিপিসহ হেফাজতি পরোয়ানামূলে আসামি/আসামিদের জেলহাজতে পাঠাবেন। প্রয়োজনে সম্পূরক নথি তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যুকারী জজ/ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরাবরে পাঠাতে হবে।

সপ্তম নির্দেশনায় বলা হয়, সংশ্লিষ্ট আসামি বা আসামিদের কোন থানার কোন মামলায় কোন আদালতের আদেশে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট জেল সুপার কিংবা অন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যুকারী আদালতকে অবহিত করবেন। পরবর্তী সময়ে আসামিদের নতুন কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেলে তা নিশ্চিত হয়ে কার্যকর করবেন জেল সুপার।

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব, আইনসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, কারা মহাপরিদর্শক ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ও হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার বরাবর পাঠাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই আদেশ প্রত্যেক দায়রা জজ ও মেট্রোপলিটন দায়রা জজ, সব ট্রাইব্যুনাল, বিশেষ আদালতের বিচারক, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের অবহিত করতে বলা হয়েছে।