ভেজাল মদের চক্রে ৩০ জন

২০-২৫ বছর ধরে বারে কাজ করেছেন নাসির আহমেদ ওরফে রুহুল। তখন থেকে মদ ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। সে সময়েই হয়ে যায় ভেজাল মদ তৈরির হাতেখড়ি। ভেজাল মদ বানিয়ে খুচরা পর্যায়ে বিক্রিও করতেন। তবে করোনা পরিস্থিতি ‘বড় সুযোগ’ এনে দেয় নাসিরের সামনে। গত বছরের মার্চে ওয়্যারহাউস বন্ধ হয়ে গেলে মদ দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। ‘সুযোগ’ কাজে লাগাতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ভেজাল মদের কারখানা। তাঁর নেতৃত্বে একটি চক্র গড়ে ওঠে।

রাজধানীর ভাটারা থানাধীন খিলবাড়িরটেক এলাকার এক বাসায় নকল সীল লাগিয়ে তৈরি করা হতো নকল মদ
ছবি: সংগৃহীত

নাসিরের এই চক্রের সরবরাহ করা মদ পানে অন্তত ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নাসিরসহ চক্রের ছয় সদস্য ধরা পড়ার আগে গত নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তাঁরা সোয়া কোটি টাকার ভেজাল মদ বিক্রি করেছেন।


ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তদন্তে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সম্প্রতি ভেজাল মদ পানে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর পর তদন্তে নেমে নাসিরের এই চক্রের সন্ধান পায় ডিবি। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিচালিত ডিবির অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় নাসিরসহ ছয়জনকে। তাঁরা এখন কারাগারে।


গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন নাসির আহমেদ, জাহাঙ্গীর আলম, সৈয়দ আল আমিন, মনতোষ চন্দ্র অধিকারী ওরফে আকাশ, রেদুয়ান উল্লাহ ও সাগর ব্যাপারী। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে সাগর ব্যাপারী ছাড়া অন্যরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

অভিযান তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার মশিউর রহমান রহমান প্রথম আলোকে জানান, নাসির আহমেদের ওই চক্রে অন্তত ৩০ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি জানান, তাঁদের কাছে তথ্য আছে চক্রের পলাতক সদস্যরা আবার ভেজাল মদ তৈরির পাঁয়তারা করছেন। তবে পুলিশও তাঁদের গ্রেপ্তারে তৎপর আছে।
ডিবি সূত্র জানায়, ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ভাটারার খিলবাড়িরটেকে নাসিরের ভেজাল মদ তৈরি কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মদভর্তি বোতল, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের খালি বোতল ও স্টিকার, জারিকেন ভর্তি স্পিরিটসহ ভেজাল মদ তৈরির বিভিন্ন উপকরণ।

জবানবন্দিতে যা আছে

নাসিরসহ গ্রেপ্তার পাঁচজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে ভেজাল মদ বিক্রির এই চক্রের নানা দিক। মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাসির আহমেদ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে খিলবাড়িরটেকে ১৩ হাজার টাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া করেন তিনি। সেখানে গড়ে তোলেন ভেজাল মদের কারখানা। কারিগর হিসেবে নিয়োগ দেন জাহাঙ্গীর আলমকে। ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দেন আল আমিনকে। তিনি (নাসির) ও জাহাঙ্গীর গুলশান ও বনানী এলাকা থেকে মদের খালি বোতল কিনতেন। এতে বোতলপ্রতি খরচ পড়ত ১০-১৫ টাকা। এ ছাড়া মিটফোর্ড এলাকার মনিরের কাছ থেকে স্পিরিট, বোতলের ছিপি ও স্টিকার সংগ্রহ করতেন তাঁরা। এই কাজের দায়িত্বে ছিলেন জাহাঙ্গীর। তিনি জাহাঙ্গীরকে ভেজাল মদ তৈরি ও মদের বোতলে ছিপি লাগানোর কাজ শিখিয়ে দেন। আল আমিনও ভেজাল মদ তৈরিতে সাহায্য করতেন। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে আল আমিন ২৩০ বোতল ভেজাল মদ রেদুয়ান, জাহিদসহ বিভিন্নজনের কাছে বিক্রি করেন। গত ২৮ জানুয়ারি আল আমিন ১০ বোতল ভেজাল ভদকা রেদুয়ানের কাছে পৌঁছে দেন।

ভেজাল মদের কারিগর জাহাঙ্গীর আলম একসময় ভাঙারি ব্যবসা করতেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গুলশান ও বনানী এলাকায় ভাঙারি ব্যবসা করতেন। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন একটি ক্লাবের ওয়েটার হিসেবে। গত বছর বন্ধু মিজানের সূত্র ধরে নাসিরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। পরে নাসির তাঁকে মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতনে কারিগর হিসেবে নিয়োগ দেন।
গত বছরের ২ ডিসেম্বর সৈয়দ আল আমিনকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেন নাসির। ভেজাল মদ তৈরি হওয়ার পর মদ ব্যবসায়ী ও গ্রাহকদের কাছে বিক্রি ও পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর। জবানবন্দিতে বলেন, রেদোয়ানের কাছে ৭০ বোতল, জাহিদের কাছে ২৪ বোতল, রিয়াজের কাছে ৩১ বোতল ভেজাল মদ বিক্রি করেছেন তিনি। এ ছাড়া অন্য লোকের কাছেও তিনি মদ বিক্রি করেছেন।


রেদোয়ান উল্লাহ আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, নাসির তাঁর কাছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলে মদ সরবরাহ করতেন। তিনি সেই মদ তাঁর পরিচিত সাগর ব্যাপারীর কাছে রাখতেন। সেখান থেকে এক বোতল মদ সাড়ে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করেন বারিধারা ডিওএইচএসের এক ব্যক্তির (যিনি ওই মদ পানের পর মারা যান) কাছে। এ ছাড়া আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মনতোষ চন্দ্র অধিকারী ওরফে আকাশ।


ভেজাল মদের কারখানায় অভিযান নিয়ে ভাটারা থানায় ও প্রাণহানির ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রিপন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ভেজাল মদ চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার করা ডায়েরিতে চক্রের ২১ সদস্যের নাম ও ঠিকানা পাওয়া গেছে। নাসির তাঁদের কাছে কবে, কত বোতল মদ বিক্রি করেন, তা-ও উল্লেখ রয়েছে। এখন তাঁদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

যা পাওয়া গেল পরীক্ষায়

ডিবি সূত্র জানায়, খিলবাড়িরটেকের ভেজাল মদের কারখানা থেকে জব্দ করা ৫ বোতল ভেজাল মদ পরীক্ষার জন্য রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ডিবির কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ বোতলে থাকা তরল পদার্থে মিথানল পাওয়া গেছে। এর মাত্রা যথাক্রমে ৮৮, ২৯.৮, ১৯.৮, ১৯.৭ ও ১৩.২ শতাংশ। বোতলে থাকা আঠালো পদার্থে আখের গুড়ের উপাদান পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মদে ইথানল বা ইথাইল অ্যালকোহল থাকবে। কিন্তু এর মাত্রা বেশি হলে দৃষ্টিশক্তি হারানোসহ মানুষের শরীরের নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। আর মিথানলযুক্ত মদ (স্পিরিট) মানেই বিষ। এতে মানুষের অঙ্গহানিসহ মৃত্যুর আশঙ্কা আছে।

ভেজাল মদ পান ও কয়েকটি মৃত্যু

গত ২১ জানুয়ারি উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় বন্ধুদের সঙ্গে মদ পান করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। ২৪ জানুয়ারি রাতে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। একই সময় মদ পানের পর অসুস্থ হয়ে পড়া ছাত্রীটির এক বন্ধু মারা যান এর আগের দিন।


২৭ জানুয়ারি আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র মদ পানের পর মারা যান হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা ওই ছাত্রের পাকস্থলীতে অ্যালকোহল বিষক্রিয়ার কথা বলেছেন।
ভাটারার খিলবাড়িরটেকে গত ১৮ জানুয়ারি একসঙ্গে মদ পান করেন এক দম্পতিসহ তিনজন। পরে তাঁরা তিনজনই মারা যান। ওই দম্পতির ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মদের বিষক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে।


গত ২৮ জানুয়ারি গাজীপুরে অবকাশযাপনে গিয়ে মদ পানের পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজধানীর একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ১৩ জন কর্মী। পরে তাঁদের মধ্যে ৩ জন মারা যান।


বারিধারা ডিওএইচএসের এক বাসিন্দা গত ২৮ জানুয়ারি খিলবাড়িরটেকের ভেজাল মদের কারখানা থেকে পাঠানো মদ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১ ফেব্রুয়ারি রাতে গুলশানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান।


রাজধানীর খিলবাড়িরটেকের ভেজাল মদ কারখানায় অভিযান ও মদ পানে মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানী ও গাজীপুরে মামলা হয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে ভাটারায় দুটি, ক্যান্টনমেন্ট ও মোহাম্মদপুরে একটি করে মামলা হয়। দুটি মামলা হয় গাজীপুরে। ভাটারা ও ক্যান্টনমেন্ট থানার দুই মামলা ডিবি ও বাকি চার মামলা তদন্ত করছে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

ভেজাল মদ পানের ক্ষতি

ভেজাল মদ পানের ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, মিথানল দিয়ে আসবাবপত্র বার্নিশ করা হয়। এটা খাওয়ার জিনিস নয়। মিথানল মানেই বিষ, এর বিষক্রিয়াই মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যুর কারণ। মিথানল বা স্পিরিট পান করলে কিডনি ও লিভার (যকৃৎ) বিকল হয় এবং চোখ নষ্ট হয়ে যায়।


আর ভেজাল মদ পানের মানসিক ক্ষতি সম্পর্কে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মিথানল খাওয়ার পর কেউ কোনোভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও তাঁর মধ্যে ধীরে ধীরে মানসিক বৈকল্য দেখা যায়। তাঁর মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দেয় ও অস্বাভাবিক চিন্তার সৃষ্টি হয়।