মনির–নাসির চক্রের ভেজাল মদে ৩৪ জনের মৃত্যু

প্রায় দেড় বছর আগে ভেজাল মদ পান করে মারা যাওয়া মামুনের মৃত্যুর জন্য সাতজনকে দায়ী করে আদালতে অভিযোগপত্র।

মৃত্যুপ্রতীকী ছবি

ভেজাল মদ তৈরির প্রধান উপকরণ স্পিরিট সরবরাহ করেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মনির হোসেন। স্পিরিট, পোড়া চিনি আর পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয় ভেজাল মদ। পরে তা ঢোকানো হয় ভাঙারি দোকান থেকে কিনে আনা পুরোনো মদের বোতলে। আসামি মনিরের সরবরাহ করা স্পিরিট দিয়ে বানানো ভেজাল মদ পান করে বিষক্রিয়ায় মারা যান ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন।

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।

ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুনের মৃত্যুর জন্য মনির হোসেনসহ সাতজনকে দায়ী করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সাত আসামি হলেন নাসির আহমেদ, জাহাঙ্গীর আলম, সৈয়দ আল আমিন, মনির হোসেন, রেদোয়ান উল্লাহ, মনোতোষ চন্দ্র অধিকারী ও সাগর ব্যাপারী।

পুলিশের প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে বিভিন্ন ওয়্যারহাউস দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। তখন আগে থেকে মদ বিক্রি করে আসা নাসির আহমেদের কাছে বিভিন্ন ব্যক্তি মদ কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে নাসির ভেজাল মদ তৈরির কথা ভাবেন। পরে তিনি তাঁর সহযোগী ভাঙারি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরকে ভেজাল মদ তৈরির প্রস্তাব দেন। জাহাঙ্গীর ভাটারায় একটি বাসা ভাড়া নেন।

ভেজাল মদ তৈরির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পান সৈয়দ আল আমিন। পরে নাসির আর জাহাঙ্গীর বিভিন্ন ভাঙারির দোকান থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের বোতল কেনেন। প্রতিটি বোতলের দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, জাহাঙ্গীর পূর্বপরিচিত মনিরের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকায় ১০ লিটার স্পিরিট সংগ্রহ করেন। প্রতিটি মদের বোতলের ছিপি সংগ্রহ করেন ৫০ থেকে ৭০ টাকায়। আর বোতলের ছিপির স্টিকার কেনা হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। দুই লিটার স্পিরিট, তিন লিটার পানি আর পোড়ানো চিনি দিয়ে পাঁচ লিটার মদ বানান জাহাঙ্গীর। পরে তা নাসিরের কাছে পাঠানো হয়।

পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ভেজাল মদ তৈরির পর তা নাসিরের নির্দেশনা অনুযায়ী মাদক ব্যবসায়ী ও গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতেন তাঁদের সহযোগী রেদোয়ান, মনোতোষ, সাগর, রিয়াজ ও জাহিদ। এক বোতল মদের দাম রাখা হয় ২ হাজার ৫০০ টাকা। মনিরের সরবরাহ করা স্পিরিট দিয়ে বানানো ভেজাল মদ পান করে ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ গাজীপুর, মোহাম্মদপুর ও ভাটারায় একাধিক মানুষ মারা যান।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মনির, মাদক ব্যবসায়ী নাসির, জাহাঙ্গীররা ভেজাল মদ তৈরি করে তা বিক্রি করেন। মনির ও নাসিরদের ভেজাল মদ পান করে করোনাকালে গাজীপুর ও ঢাকায় ৩৪ জন মারা যান বলে জানা যায়। তবে স্বজনেরা বিষয়টি চেপে যান বলে জানান এই ডিবি কর্মকর্তা।

ব্যবসায়ী মামুনের মৃত্যু কীভাবে? রাজধানীর বারিধারা এলাকায় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা পরিচালনা করতেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি গত বছরের ২৯ জানুয়ারি মদ পানের পর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

পরে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। মামুনের মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ী নাসিরের সহযোগী মনোতোষ ও রেদোয়ান এক বোতল ভেজাল মদ ব্যবসায়ী মামুনকে পৌঁছে দেন, যা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধরা পড়ে।

পরে বারিধারার অফিসে বসে মামুন তাঁর এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সেই মদ পান করেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মিথানল বিষক্রিয়ায় মারা যান মামুন। মামুনের স্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেজাল মদ পান করে আমার স্বামী মারা গেলেন। দুই সন্তান নিয়ে আমি অনেক কষ্টে আছি। অথচ আমার সুখের সংসার ছিল। মানুষ নামের যেসব অমানুষ ভেজাল মদ বানিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আমি বিচার চাই।’