মাদক নির্মূলে এবার ওসির 'গায়েবি হামলা'

কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই ভিডিওতে তিনি বলেছেন, টেকনাফের প্রতিটি পাড়া–মহল্লার ইয়াবা কারবারিদের গ্রেপ্তার করা হবে। যাঁদের পাওয়া যাবে না, তাঁদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, যানবাহন সমূলে উৎপাটন করা হবে। তাঁদের বাড়িতে গায়েবি হামলা হবে। কোনো কোনো বাড়ি ও গাড়িতে গায়েবি অগ্নিসংযোগও হতে পারে।

ওসির এই ভীতিকর ভিডিও বার্তা নিয়ে কক্সবাজারে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এভাবে গায়েবি হামলা ও অগ্নিসংযোগের হুমকি দিতে পারেন কি না।

কক্সবাজারের বাসিন্দারা বলছেন, মাদক নির্মূলে সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এখন মাদক কারবারিদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও তাঁদের নৌযান পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ তৎপরতা বেশ আগে থেকেই গোপনে চলে আসছিল। করোনাকাল শুরু হওয়ার আগের কয়েক মাসে ১৫০টি বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু এবার ওসির মুখ থেকে ঘোষণা আসায় এ নিয়ে জনমনে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। মাদক বন্ধের নামে এমন বেআইনি তৎপরতাকে কেউ কেউ ‘সন্ত্রাস ঠেকাতে নতুন সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করছেন।

গতকাল শুক্রবার নিজের ভিডিও বক্তব্যের পক্ষে সাফাই গেয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ প্রথম আলোকে বললেন, ‘আগে থেকেই এখানে এসব (হামলা–অগ্নিসংযোগ) ঘটে আসছে, মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে সেটা করছে। এখনো তা হতে পারে জেনেই ভিডিও বার্তায় সে কথা উল্লেখ করেছিলাম।’ তিনি বলেন, দুই-তিন হাজার ইয়াবা কারবারির জন্য টেকনাফের লাখ লাখ মানুষ বদনামের ভাগী হতে পারেন না।

জেলা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক নির্মূলে সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ১ জুলাই থেকে নতুন করে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক চান ১৬ ডিসেম্বরের আগে সারা দেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা। টেকনাফের ওসি যে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন, তা সেই অভিযানেরই সতর্কবার্তা।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধি এভাবে কথা বলতে পারেন না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। পুলিশের উচিত, এ ধরনের মন্তব্য করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। এটা অপরাধ করার জন্য উসকানি দেওয়া। এখন অন্য কেউ যদি এ অপরাধ করে, তাহলে তার দায় ওসিকেই বহন করতে হবে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিডিওতে ওসি কী বলেছেন, সেটা আমি দেখিনি। এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারব না।’ একই কথা বলেছেন চট্টগ্রামের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক।

দুই বছর আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে সাঁড়াশি অভিযান আর কথিত বন্দুকযুদ্ধের পর অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, দেশে মাদকের পাচার ও কেনাবেচা কমে যাবে। কিন্তু ফলাফল হয়েছে উল্টো। অভিযান শুরুর দুই বছরের মাথায় এসে দেখা গেছে, মাদকের আমদানি ও কেনাবেচা কমেনি, বরং তা বেড়ে গেছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বলছে, এত কিছুর পরও ইয়াবা আসা বন্ধ তো দূরের কথা, বরং তা ভারত হয়ে সিলেট, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।

ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই

মাদকের ভয়াবহতা রোধে ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী অভিযানের ঘোষণা দিয়েছিল পুলিশ। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত সেই অভিযানে শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৮০ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে রোহিঙ্গা ৯৩ জন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬৯ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬০ জন ও র‍্যাবের সঙ্গে ৫১ জন। কিন্তু তারপরও ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই।

সরকারিভাবে ধরে নেওয়া হয়, দেশে ৬০ থেকে ৭০ লাখ লোক মাদকাসক্ত। তারা মাদকের পেছনে বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। দেশব্যাপী এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিন হাজারের মতো ব্যবসায়ী, যাঁদের সাড়ে তিন শর মতো গডফাদার রয়েছে। এসব ব্যবসায়ী ও গডফাদার সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর তালিকাভুক্ত। কিন্তু এত বড় অভিযানে তাঁরা ধরা পড়ছেন না।

এখনো বড় বড় ইয়াবার চালান যে আসছে, তা স্বীকার করেই কক্সবাজারে পুলিশ সুপার বললেন, সেটা রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে আসছে। তাঁর দাবি, টেকনাফে আগে যাঁরা ইয়াবা ব্যবসা করতেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ এখন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। দুই দফায় ১২৩ জন ইয়াবা কারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।

পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে বান্দরের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় চালান আনা হচ্ছে। উখিয়ার রহমতের বিল মৎস্য প্রকল্প দিয়েও ইয়াবা আসছে। চিংড়ি প্রজেক্টের বহু মালিক-শ্রমিক এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বড় চালানের আরেকটি অংশ ঢুকছে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত ও বান্দরবান সদর এলাকা হয়ে। সব চালান এসে মজুত হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, মিয়ানমার এখন বাকিতে ইয়াবা দিচ্ছে। সেই বাকির ইয়াবা দিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ইয়াবার ডিপোতে পরিণত হয়েছে।

বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের দুর্গম পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা চোরাচালান বেড়েছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সময়ে বিজিবি একাধিক অভিযান চালিয়ে ১৫ লাখের বেশি ইয়াবা বড়িসহ ৯৯ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী।

ইয়াবা লুটও হচ্ছে

কক্সবাজারের বাসিন্দারা বলছেন, ইয়াবা পাচারের পাশাপাশি এক পক্ষ অন্য পক্ষের ইয়াবা লুটও করছে। সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কক্সবাজার শহরের মাঝিরঘাট এলাকার আবু ছৈয়দ কোম্পানির জেটি দিয়ে খালাস হওয়ার সময় প্রায় এক কোটি ইয়াবা বড়ি লুট হয়। টেকপাড়ার মিজানুর রহমান সিন্ডিকেট এ ইয়াবা লুট করে বলে অভিযোগ আছে। পুলিশ খবর পেয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি মাঝিরঘাট থেকে দুই লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে। মিজানের দুই সহযোগী ফিরোজ আহমদ ও মোস্তাক আহমদ নামের দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারের দিকে সবার নজর থাকার কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রুট ও হাত বদল করছেন। এখন নতুন নতুন বিক্রেতা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে নতুন চক্রের সক্রিয় হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া মাদকবিরোধী অভিযান চলতে থাকায় ছোট ও মাঝারি মানের মাদক ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আড়ালে চলে গেছেন।

ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ হাজার ২৫০

জেলা পুলিশের সর্বশেষ তালিকায়, কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে শুধু টেকনাফে রয়েছেন ৯১২ জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা তালিকায় কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি আছেন ৭৩ জন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সব তালিকায় মাদকের ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি ও তাঁর পাঁচ ভাই, এক বোনসহ ২৬ জন নিকটাত্মীয়ের নাম আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁরা আত্মসমর্পণ করেননি।

তবে বদি প্রায় সময় বলে আসছেন, তিনি কোনো দিন মাদক ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন না। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা খেয়ে প্রশাসনের লোকজন ইয়াবা তালিকায় তাঁর নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

 কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি ফোরামের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, বন্দুকযুদ্ধে দুই শতাধিক কারবারির মৃত্যু হলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন। ফলে ইয়াবার মতো ভয়ংকর মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।