মিথ্যে দলিলে ভিটে গেছে, প্রাণও গেছে

বরকত ও রুবেল

এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার কাহিনি। ঋণের দায়ে সব হারানো উপেনের সম্বল বলতে ছিল দুই বিঘা ভিটে জমি। সে জমিতেই চোখ পড়ে রাজার। উপেন তা বেচতে না চাইলেও মিথ্যে দেনার দায়ে ডিক্রি নেন রাজা। আর বসতভিটে খুইয়ে দেশান্তরি হন উপেন।

ফরিদপুরের অশোক কুমার দাসকে অবশ্য ভিটেমাটি ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে দেশান্তরি হতে হয়নি। তার আগেই তিনি চলে গেছেন পরপারে। তাঁর মৃত্যুর পর রাজা সেজে সেই জমিতে জেঁকে বসেন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনের (বরকত) ছোট ভাই ইমতিয়াজ হাসান (রুবেল)। অশোক দাসের এই ভিটে দখলের ঘটনা কল্পকাহিনির চেয়ে কম বিস্ময়কর নয়।

প্রথিতযশা আইনজীবী অশোক কুমার দাসের ভিটে দখলের এই ঘটনা ফরিদপুরে সচেতন মানুষেরা জানতেন। কিন্তু ভয়ে এত দিন কেউ টুঁ শব্দ করেননি। দুই ভাই গ্রেপ্তারের পর অনেক ঘটনার সঙ্গে আইনজীবীর বসতবাড়ি দখলের কাহিনিও বেরিয়ে আসে।

রুবেল ও বরকত এখন কারাগারে। তাঁরা ছিলেন ফরিদপুর সদরের সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এবং তাঁর ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেনের (বাবর) ঘনিষ্ঠ। এই ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা চাঁদাবাজি, জমি দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হন। গত ৭ জুন তাঁদের গ্রেপ্তারের পর ১১টি মামলা হয়। এসব মামলায় আদালতে ও পুলিশের কাছে তাঁরা জবানবন্দি দেন। সেই জবানবন্দিতে অশোক কুমার দাসের জমি দখলের কথাও স্বীকার করেন রুবেল। গত ২৮ জুলাই প্রথম আলোয় ‘ফরিদপুরে দুই ভাই কাহিনি, সন্ত্রাসীদের হাতে রাজনীতির “চেরাগ”’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

রুবেলের চোখ জমির ওপর

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের মছলন্দপুর গ্রামের আশুতোষ দাসের ছেলে অশোক দাস। তাঁর মাতামহ রায় বাহাদুর বিনোদ লাল ভদ্র ছিলেন ব্রিটিশ আমলে জজকোর্টের আইনজীবী। সেই সময়ে নাতি অশোক দাসকে শহরের দক্ষিণ কালীবাড়ি মহল্লার তমিজউদ্দিন খান সড়কে ২৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ জমি দানপত্র করে দেন। সেই দলিলমূলে বাড়ি করে এ জমিতে বসবাস করছিলেন অশোক।

অশোক দাস ছিলেন নিঃসন্তান। কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে বাড়িতে রাখছিলেন। বাড়িটি ফরিদপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত। দামি জায়গা বলে সেই জমির ওপর চোখ পড়ে রুবেলের। জমিটি দখলের জন্য তিনি নানা চেষ্টা ও ভয়ভীতি দেখান। একপর্যায়ে জমিটি বিক্রি করতে অশোক দাসকে বাধ্য করেন। ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর একটি বায়নানামা রেজিস্ট্রি করেন রুবেল। দাম ঠিক হয় ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। বায়না হিসেবে তাৎক্ষণিক ৭০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ছয় মাসের মধ্যে বাকি ২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বায়না দলিলে উল্লেখ করা হয়।

বায়নার সময় সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অশোক দাস তখন অসুস্থ ছিলেন। চারজন লোক তাঁকে বাড়ি থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসেন। সেভাবেই কৃষি ব্যাংক ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসেন। সেখানে বসেই বায়না দলিল হয়। অশোক দাস খুবই বিমর্ষ ছিলেন। তিনি কাঁপছিলেন, কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। বায়নার ৭০ লাখ টাকা নেন কুমারেশ দত্ত নামের এক ব্যক্তি। কুমারেশ দীর্ঘদিন ধরে অশোক দাসের বাড়িতেই থাকতেন।

অশোক দাসের জমি বায়না করার কাজে যুক্ত ছিলেন ফরিদপুর জজকোর্টের আইনজীবী জাহিদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই জমি বায়না করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বায়নার শর্ত অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে বাকি টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নেননি রুবেল।

জমি দখল

ভিটে জমি বিক্রির বায়না রেজিস্ট্রি করার ১ বছর ৬ মাস ৩ দিন পর ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল ৭৮ বছর বয়সে অশোক দাস মারা যান। তাঁর মৃত্যু ছিল রহস্যজনক। অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। অশোক দাসের মৃত্যুর এক দিন পর বাড়ির তিনটি টিনের ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর চারপাশে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে জমিটি দখল করেন রুবেল।

অশোকের ওই বাড়িতে তিনি ছাড়াও আইনজীবী অকৃতদার কুমারেশ দত্ত, তাঁর সহকারী প্রফুল্ল বিশ্বাস, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে এবং পাঁচ শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রফুল্ল বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, অশোক দাসের মৃত্যুর এক দিন পর রুবেল এসে সবাইকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। তাঁদের ভয়ে সবাই বাড়ি খালি করে চলে যান।

ভারত থেকে কথিত ভাই হাজির

অশোক দাসের মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অসীম কুমার দাস নামের এক ভারতীয় নাগরিক তাঁর এক ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে ফরিদপুরে আসেন। তিনি নিজেকে মৃত অশোক দাসের ভাই বলে পরিচয় দেন। এই অচেনা লোকটি নিজেকে শহরের দক্ষিণ কালীবাড়ির স্থায়ী নাগরিক দেখিয়ে পৌরসভা থেকে জন্মসনদও নেন। এরপর অশোক দাসের জমির ‘নিরঙ্কুশ মালিক’ সেজে জমিটি রেজিস্ট্রি করে দেন। বায়নানামা রুবেলের নামে থাকলেও জমিটি রেজিস্ট্রি করা হয় রুবেলের ব্যবসায়িক অংশীদার জামাল আহমেদ খানের নামে।

এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওই রেজিস্ট্রির প্রথম সাক্ষী হন রুবেল নিজে। আর দ্বিতীয় সাক্ষী হন অসীমের ভাতিজা পরিচয় দেওয়া অরিত্র কুমার দাস। ফরিদপুর পৌরসভার সনদ অনুযায়ী অরিত্র স্থায়ী ঠিকানা দেন শহরের দক্ষিণ কালীবাড়ি। দলিলটির লেখক ছিলেন মহিবুর রহমান। রেজিস্ট্রি করেন সাবরেজিস্ট্রার এ কে এম রফিকুল কাদির।

জালিয়াতির কষা ছক

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, অশোকের মৃত্যুর পর রুবেল জমিটি গ্রাসের ছক কষেন। সেই ছক অনুসারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে অশোকের ছোট ভাই পরিচয় দেওয়া অসীম ও ভাতিজা পরিচয় দেওয়া অরিত্রকে ২০১৯ সালের আগস্ট ও অক্টোবরে দুই দফা ফরিদপুরে আনা হয়। অক্টোবরে পাসপোর্ট নিয়ে তাঁদের ফরিদপুরে আসার ব্যাপারে বেনাপোল সীমান্তে তথ্য রয়েছে। তবে আগস্টে আসার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। এ তথ্য জানিয়েছেন ফরিদপুর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সুনীল কর্মকার। দুই দফায় আট দিন করে তাঁরা শহরের পদ্মা নামের একটি আবাসিক হোটেলে ওঠেন।

পদ্মা হোটেলের ব্যবস্থাপক আশিস নাগ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালের ১ আগস্ট অসীম ও অরিত্র এ হোটেলে ওঠার দুই দিন আগে শহরের আইনজীবী শীতল টিকাদার এসে তাঁদের জন্য রুম বুকিং দেন। তাঁরা আসার পর শীতল টিকাদার ও জাহিদ হোসেন নামের আরেক আইনজীবী তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী শীতল টিকাদার প্রথম আলোকে বলেন, অসীম ও অরিত্রকে তিনি শুধু শনাক্ত করেছিলেন। এর বেশি কিছু জানেন না। অন্যদিকে আইনজীবী জাহিদ হোসেন বলেন, রুবেল বায়নার শর্ত লঙ্ঘন করার পর তিনি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আর যুক্ত থাকেননি।

ভুয়া সনদ দেয় পৌরসভা

২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট অসীমকে ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ কালীবাড়ি মহল্লার স্থায়ী বাসিন্দা দেখিয়ে জন্মসনদ দেয় ফরিদপুর পৌরসভা। পৌর কর্তৃপক্ষ ওই ভারতীয় নাগরিককে শুধু জন্মসনদই দেয়নি, অশোক দাসের উত্তরাধিকারী বলে ওয়ারিশ সনদও দিয়েছে।

পৌর মেয়র শেখ মাহাতাব আলীর সই করা ওই উত্তরাধিকার সনদ অনুযায়ী অশোক কুমার দাস মৃত্যুর সময় ভাই অসীম কুমার দাস ও ভাতিজা অরিত্র দাসকে ওয়ারিশ হিসেবে রেখে যান। এর সনদবলেই অসীম জমিটির দলিল করে দেন।

উত্তরাধিকার ও জন্মসনদ বাতিল

অশোক দাসের জমি রেজিস্ট্রি করার পর অসীম ও অরিত্র ভারতে চলে যান। ৭ জুন রাতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে রুবেল ও বরকত গ্রেপ্তারের পর সব উল্টে যায়। জালিয়াতি করে অশোক দাসের জমি দখলের অভিযোগ ওঠে। এরপর ফরিদপুর পৌরসভা গত ৪ আগস্ট অসীম কুমার দাস ও অরিত্র দাসের জন্ম এবং উত্তরাধিকার সনদ বাতিল করে দেয়।

সনদ বাতিল প্রতিবেদনে বলা হয়, অসীম ও অরিত্র স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করেন। কিন্তু তাঁরা কাউন্সিলরকে ভুল তথ্য দিয়ে সত্য গোপন করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জন্ম ও উত্তরাধিকার সনদ গ্রহণ করেন।

ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র শেখ মাহাতাব আলী প্রথম আলোকে বলেন, পৌর কাউন্সিলর নাসির উদ্দিনের সুপারিশ থাকায় তিনি সরল বিশ্বাসে ওই সনদে সই করেছিলেন। অশোকের বাড়িতে বসবাস করা কুমারেশ দত্তের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব সনদ দেওয়া হয়েছিল।

তবে কুমারেশ দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো আবেদন করেননি। কারা করেছে, তা–ও তিনি জানেন না।

অশোক দাসের জমি এভাবে দখলের ব্যাপারে ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শিপ্রা গোস্বামী বলেন, একটি চক্র এই জমি দখল করেছে। তারা সংঘবদ্ধভাবেই জালিয়াতি করেছে। যারা জাল সনদ দিয়েছে, তারাও এ থেকে বাদ নেই। এদের সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, অশোক দাসের কথিত ভাই ও ভাতিজাকে ভারত থেকে ফরিদপুরে এনে জমি রেজিস্ট্রির কাজ তদারক করেছিলেন ফরিদপুর জজকোর্টের আইনজীবী শীতল টিকাদার। এ জন্য তিনি মোটা পারিশ্রমিকও পান। তবে শীতল টিকাদার এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ওই দলিলের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। শুধু আইনজীবী অশোক দাসের ভাই অসীম কুমার দাস এবং অশোক দাসের ভাই মৃত অরুণ কুমার দাসের ছেলে অরিত্র দাসকে শনাক্ত করেছিলেন।

এত দিন যাঁরা ভারতে বসবাস করছিলেন, তাঁদের কীভাবে চিনলেন? এ প্রশ্নের জবাবে শীতল টিকাদার বলেন, ‘চেহারার মিল দেখে শনাক্ত করি।’

জমি দেখিয়ে ঋণ

আইনজীবী অশোক দাস মারা যান ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল। তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক হয়নি বলে শহরে ব্যাপক আলোচনা আছে।

অশোকের জমি দখলের পর তড়িঘড়ি করে সেই জমি পূবালী ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নেন জালাল আহমেদ খান নামের এক ব্যক্তি। তবে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, তা বলতে রাজি হননি ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. হাফিজুর রহমান। ঋণগ্রহীতা জামাল আহমেদ খানও কোনো কথা বলতে চাননি। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, দখল করা জমি বন্ধক দিয়ে এভাবে বেনামি ঋণ নিতেন রুবেল ও বরকত।

অশোক দাস মারা গেছেন, তাঁর কোনো উত্তরাধিকার নেই। পড়ে আছে শুধু খালি বসতভিটে। যেখানে ব্যাংকের দায়-দেনার সাইনবোর্ড ঝুলছে। অশোক দাসের জমি যাঁরা দখল করেছিলেন, সেই রুবেল-বরকতও এখন কারাবাসে। অভিযানের পর তাঁদের ঘনিষ্ঠরাও শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শুধু নির্যাতন ও জালিয়াতির সাক্ষী হয়ে আছে প্রয়াত অশোক দাসের শূন্য বসতভিটে।