মুক্তিযোদ্ধাকে নানা দেখিয়ে কৃষি কর্মকর্তার চাকরি

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জয়পুরহাটের আক্কেলপুর কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাসমিন ইফফাত। সরকারি নথি অনুযায়ী, তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভুয়া নানা সাজিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

তাসমিনের বাবা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান উচ্চমান সহকারী (বর্তমানে অবসরে) আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ-বাণিজ্য, চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে। আবুল হোসেনের বাড়ি বগুড়া সদর উপজেলার মেঘাগাছা গ্রামে। তিনিই মেয়ে তাসমিনকে মুক্তিযোদ্ধার কোটা জালিয়াতি করে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।

এ ঘটনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক তদন্ত কমিটি গঠন করলেও পরে তাঁর নির্দেশেই তদন্তকাজ স্থগিত হয়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তাসমিনের জমা দেওয়া নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর নানা একজন মুক্তিযোদ্ধা। নাম মো. মোকাদ্দেস হোসেন। বাড়ি পাবনা সদরের চকপৈলানপুর গ্রামে। মোকাদ্দেসকে নানা দাবি
করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেন তাসমিন।

তিনি গত বছরের ১৫ জানুয়ারি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে বগুড়ায় যোগ দেন।
মুঠোফোনে জানতে চাইলে পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, পাবনা সদরে মোকাদ্দেস নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি প্রায় এক বছর হলো মারা গেছেন। তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন বগুড়ায় নেই।

তাসমিন ইফফাতের বাবা আবুল হোসেন সদরের মেঘাগাছা গ্রামেই বিয়ে করেছেন। তাঁর নানার নাম মো. মোজাহার আলী (৮০)। ৯ মার্চ মেঘাগাছা গ্রামে গিয়ে কথা হয় মোজাহার আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর নাতনির তাসমিনের ডাকনাম সম্পা। সম্পা ও নাতি মাসুদ রানা পারভেজ (তাসমিনের ভাই) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে চাকরি করেন। তবে পাবনায় তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। আর তিনি (মোজাহার) মুক্তিযোদ্ধা নন।

তাসমিন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেওয়ার বিষয়টি তদন্তের জন্য গত বছরের জুনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালকের কাছে লিখিত আবেদন করেন একই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁদের পক্ষে আবেদনে স্বাক্ষর করেন জালাল উদ্দিন নামের একজন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাসমিনের বাবা বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রধান উচ্চমান সহকারী (বর্তমানে অবসরে) আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ-বাণিজ্য, চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। আবুল হোসেনের বাড়ি বগুড়া সদর উপজেলার মেঘাগাছা গ্রামে। তিনি তাঁর মেয়ে তাসমিনকে মুক্তিযোদ্ধার কোটা জালিয়াতি করে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।

এ অভিযোগের অনুলিপি দেওয়া হয় কৃষি মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) ৯টি কার্যালয়ে।

আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে ‘ঘুষ-বাণিজ্যের’ অভিযোগ পাওয়ার পর গত বছরের ১০ ডিসেম্বর এক চিঠিতে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণের মহাপরিচালককে অনুরোধ করেন দুদকের উপপরিচালক (অনু ও তদন্ত-১) এস এম মফিদুল ইসলাম। তদন্ত সাপেক্ষে এক মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নিয়ে অবহিত করতে বলা হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে। এ প্রেক্ষাপটে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (এলএসএস) কবীর আহমেদ বিষয়টি তদন্তের জন্য চলতি বছরের ২ জানুয়ারি বগুড়া কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালককে চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আবুল হোসেনের বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে একটি সুনির্দিষ্ট মতামত দুদককে দিতে হবে। বিষয়টি অতীব জরুরি।’

তবে এসব চিঠির তদন্তকাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ কারণে ১২ ফেব্রুয়ারি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (এলএসএস) কবীর আহমেদ আবার চিঠি দেন বগুড়া কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালককে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি, যা মোটেও কাম্য নয়। এই চিঠি পাওয়ার পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আবার অনুরোধ করা হলো।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০ ফেব্রুয়ারি আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তের জন্য চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়ের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মো. শামছুল ওয়াদুদকে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘বিনা ব্যর্থতায় তদন্ত শেষে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দপ্তরে দাখিলের জন্য বলা হলো।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহা. কামাল উদ্দিন তালুকদার এ নির্দেশ দেন। তবে শেষ পর্যন্ত এই তদন্ত কমিটিও আলোর মুখ দেখেনি। এই তদন্ত থেমে যায় ৩ মার্চের এক চিঠিতে (স্মারক-৬৪৯)। শামছুল ওয়াদুদকে তদন্ত ‘স্থগিত’-এর চিঠি দেন কামাল উদ্দিন তালুকদার।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, ‘আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে ৪ মার্চ বগুড়া ও ৬ মার্চ পাবনায় কাজ করার কথা কমিটির। কিন্তু অধিদপ্তরের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, এটা আমাদের তদন্ত করতে হবে না। দুদক করবে। এ কারণে তদন্ত বন্ধ হয়ে গেছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করার দরকার নেই। এটা ভুলে হয়ে গেছে। মেয়েকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’

এদিকে তাসমিন ইফফাত বলেন, ‘আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর চাকরি করি না।’ চাকরি ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। পাবনার মুক্তিযোদ্ধাকে নানা সাজিয়ে চাকরি নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ তথ্য কার কাছে শুনেছেন? এরপর ফোন কেটে দেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কামাল উদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘শুনেছি জয়পুরহাট কার্যালয়ের মাধ্যমে তাসমিন চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে সেখানে একটি আবেদন করেছেন। আবেদনটি জয়পুরহাট থেকে আমার কাছে পাঠানোর কথা। তবে এখনো হাতে পাইনি।’

তদন্তকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কামাল উদ্দিন তালুকদার বলেন, আবুল হোসেন ও তাঁর মেয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে ঢাকা থেকে জানানো হয়েছে, তারা আগের তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছে। এ কারণে নতুন করে আর তদন্ত করা হচ্ছে না।