রায় বিক্রি হলে যাওয়ার জায়গা থাকে না

  • নিজেদের কেনা সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় উঠে গেছে দাবি করে মামলাটি হয়েছিল।

  • ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত রায় দেন। এই রায় অযৌক্তিক, অসৎ অভিপ্রায়, অসৎ উদ্দেশ্যে ও স্বেচ্ছাচারী বলে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্ট ভবন
ফাইল ছবি

বিচার বিভাগ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণ বিকল্প উপায় খুঁজতে বাধ্য হবে, যেটি কল্পনাও করা যায় না বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, আমূল সংস্কার করে, দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে বিচার বিভাগকে নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সময় এসেছে এখন।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। ১৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়।

পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে করা পৃথক দুটি রিটের ওই রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ জায়গা তথা শেষ আশ্রয়স্থল হলো বিচার বিভাগ। যখন এই শেষ আশ্রয়স্থলের বিচারকগণ দুর্নীতির মাধ্যমে রায় বিক্রি করেন, তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। তাঁরা হতাশ হন, ক্ষুব্ধ হন, বিক্ষুব্ধ হন এবং বিকল্প খুঁজতে থাকেন। তখন জনগণ মাস্তান, সন্ত্রাসী এবং বিভিন্ন মাফিয়া নেতাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তাঁদের বিচার সেখানে চান।’

হাইকোর্ট বলেছেন, ‘নষ্ট বিচারক, পচা বিচারক এবং দুর্নীতিবাজ বিচারক ভালো বিচারকদের আস্তে আস্তে নষ্ট করে ফেলবে।’

আদালত সূত্র জানায়, নিজেদের কেনা সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় উঠে গেছে দাবি করে মামলাটি হয়েছিল। এ নিয়ে চার ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে ঢাকার কাকরাইলের সাড়ে ১৬ কাঠা জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত রায় দেন। এর বৈধতা নিয়ে সরকারপক্ষ ২৪ বছর পর ২০১৯ সালে হাইকোর্টে পৃথক দুটি রিট করে। চূড়ান্ত শুনানি শেষে সেটেলমেন্ট আদালতের ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে হাইকোর্ট রায় দেন। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, প্রথম সেটেলমেন্ট আদালতের রায় ও আদেশ অযৌক্তিক, অসৎ অভিপ্রায়, অসৎ উদ্দেশ্যে ও স্বেচ্ছাচারী। সর্বোপরি রায় ও আদেশ ন্যায়বিচার বা প্রাকৃতিক বিচারের নিয়মবিরোধী বা পরিপন্থী।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ‘পচা আপেল ভালো আপেলগুলো থেকে সরিয়ে ফেলো। কারণ, একটি বাক্সে বা ঝুড়িতে একটি পচা আপেল অন্য আপেলগুলোকে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। সেহেতু বিচার বিভাগের সকল বিচারককে যদি দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হয়, তাহলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হলো, সকল দুর্নীতিবাজ বিচারককে অনতিবিলম্বে এবং দ্রুততার সাথে উপড়ে ফেলে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। তা না হলে এসব নষ্ট বিচারক, পচা বিচারক এবং দুর্নীতিবাজ বিচারক ভালো বিচারকদের আস্তে আস্তে নষ্ট করে ফেলবে।’

আদালত বলেছেন, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি দুর্নীতগ্রস্ত হন, তাহলে আইনের শাসন বই-পুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকবে, এটি বাস্তব রূপ লাভ কখনোই করবে না। সমাজে, বুদ্ধিজীবী মহলে, পত্রপত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অসংখ্য খবর, প্রতিবেদন, লেখা ছাপা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ বিচারকদের (নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত) কীভাবে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট প্রতিবেদন, লেখা ও গবেষণা দেশে দেখা যায়নি।

পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে প্রথম সেটেলমেন্ট আদালতের দেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ঢাকার তৎকালীন প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং জালিয়াত চক্রকে বিনা দালিলিক এবং সাক্ষ্য ব্যতিরেকে হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় এবং জনগণের সম্পত্তি জালিয়াত চক্রের হাতে তুলে দেন। আরও বলা হয়, হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রের সম্পত্তি, হাজার কোটি টাকার জনগণের সম্পত্তি, হাজার হাজার কোটি টাকার দেশের সম্পত্তি প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত ন্যূনতম দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকে জালিয়াত, ঠক, বাটপার এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের হাতে তুলে দিয়েছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘আমরা বিচার বিভাগ যদি ব্যর্থ হই, জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে তাহলে জনগণ বিকল্প উপায় খুঁজতে বাধ্য হবে, যেটি কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং এখন সময় এসেছে আমাদের বিচার বিভাগকে তথা জনগণের শেষ আশ্রয়স্থলকে আমূল সংস্কার করে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে সত্যের নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার।’

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ আইনের শাসনের অন্যতম শর্ত। দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ গড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অনতিবিলম্বে বসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ না করলে ভালো আপেলগুলো তথা ভালো বিচারকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ শঙ্কা দেখা যাচ্ছে।

রায়ে আরও বলা হয়, জনগণের সম্পত্তি দেখভালের সর্বশেষ স্তরে জনগণ বিচারকদের ওপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার অর্পণ করেন। সুতরাং বিচারকদের বিশাল গুরুদায়িত্ব হলো জনগণের সম্পত্তি যেন কোনো জোচ্চোর, ঠক বাটপার ও জালিয়াত চক্র গ্রাস করতে না পারে।

হাইকোর্টের রায়ে ওই নালিশি সম্পত্তি (হোল্ডিং ৫৬ ও ৫৭ নম্বর কাকরাইল, রমনা) যেন কোনো জালিয়াত ও প্রতারক চক্র দখল না করতে পারে, সে জন্য ওই সম্পত্তি নিউরো ডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টকে (পদ্মা লাইফ টাওয়ার, ১১৫ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ) প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে দখল ও ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অবৈধ দখলদারের হাত থেকে ওই নালিশি সম্পত্তি উদ্ধার করে নিউরোডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করতে ঢাকার জেলা প্রশাসককে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে আদেশ প্রতিপালন বিষয়ে জেলা প্রশাসককে হলফনামা দিতে বলা হয়েছে।