শ্রমিক সংকট, অথচ বাইরে খাটছে 'কম্বাইন্ড হারভেস্টর'

রাজশাহীর পবা উপজেলার বিল নেপালপাড়া গ্রামের বর্গাচাষি কামরুজ্জামান শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে পারছিলেন না। গত শনিবার তাঁর দুই বিঘা জমির ধান কেটে দিয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের নেতা-কর্মীরা। অথচ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দী করার জন্য ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টর’ নামের একটি যন্ত্র দেওয়া হয়েছে। এই যন্ত্র দিয়ে মাত্র ৭০০ টাকায় এক বিঘা জমির ধান কেটে নেওয়া যায়।

কৃষক সমিতির মাধ্যমে এই যন্ত্র পরিচালনা করার কথা। কিন্তু যন্ত্রটি জেলার বাইরে ইজারা দিয়েছেন সমিতির সভাপতি। জেলার মোহনপুর উপজেলায়ও সমিতিকে দেওয়া যন্ত্রটি জেলার বাইরে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাইরে ভাড়া দেওয়ায় জেলার অন্যান্য উপজেলায়ও শ্রমিক সংকটের এই দুঃসময়ে যন্ত্রগুলো কোনো ভূমিকা রাখছে না বলে কৃষকদের অভিযোগ। আর সমিতির নেতারা বলছেন, রাজশাহীর কৃষকেরা যন্ত্রে ধান কাটতে চান না। এ জন্য যন্ত্র বাইরে পাঠিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয় থেকে জানা গেছে, যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বাড়ানো প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) আওতায় ২০১৭ সালে রাজশাহীর প্রতিটি উপজেলায় কম্বাইন্ড হারভেস্টর যন্ত্র সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া শুধু ধান ও গম কাটার জন্য রিপার যন্ত্র, চারা রোপণের জন্য রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, বীজ বপনের জন্য সিডার এবং ধান-গম শুধু মাড়াই করার জন্য মাড়াই যন্ত্র সরবরাহ করা হয়। কম্বাইন্ড হারভেস্টর দিয়ে একসঙ্গে ধান বা গম কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দী করা যায়। যন্ত্রগুলো স্থানীয় কৃষকদের সমিতিকে দেওয়া হয়। সমিতির কাছ থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে ভাড়া নিয়ে কৃষকেরা তাঁদের ফসল কাটবেন। যন্ত্রগুলো সমিতির কৃষিযন্ত্র সেবাকেন্দ্রে রাখার কথা।

বিল নেপালপাড়ার কৃষক কামরুজ্জামান জানান, এবার ধানের দাম কম হওয়ায় আগের মতো ধানের বিনিময়ে কেউ ধান কেটে দিতে রাজি হন না। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য সরকারিভাবে কোনো যন্ত্র দেওয়া হয়েছে এমন তথ্য তিনি জানেন না। তবে খবর পেয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন রাজশাহী মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় এবং পবা উপজেলার নেতা-কর্মীরা তাঁর ধান কেটে দিতে এসেছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পবায় কম্বাইন্ড হারভেস্টর যন্ত্রটি উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের ‘ধর্মহাটা কৃষক আইপিএম ক্লাবকে’ দেওয়া হয়েছে। এই ক্লাবের ভাড়াভিত্তিক কৃষিযন্ত্র সেবাকেন্দ্রে গিয়ে যন্ত্রটি পাওয়া যায়নি। একজন নারী নিজেকে সভাপতির আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বলেন, যন্ত্রটি এখন পাবনায় ধান কাটছে। সভাপতি মিজানুর রহমান বাড়িতে ছিলেন না। মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও ধরেননি। তবে সাধারণ সম্পাদক আবদুল হালিম বলেন, তাঁরা যন্ত্রটি এক বছরের জন্য ১৭ হাজার ৩০০ টাকায় সভাপতিকে ইজারা দিয়ে রেখেছেন। সভাপতি যন্ত্রটি আত্রাই পাঠিয়েছেন। এখন কোথায় ধান কাটা হচ্ছে, তা তিনি জানেন না।

মোহনপুর উপজেলায় এই যন্ত্র মহিষকুণ্ডি সিআইজি সমবায় সমিতিকে দেওয়া হয়েছে। তাদের ভাড়াভিত্তিক কৃষিযন্ত্র সেবাকেন্দ্রে যন্ত্রটি পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজন জানান, যন্ত্রটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধান কাটার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি আবদুল জলিলকে পাওয়া যায়নি। তাঁরও মুঠোফোনটি বন্ধ। সাধারণ সম্পাদক সত্যেন সরকার বলেন, যন্ত্রটি কোথায় আছে, তিনি জানেন না।

সেখান থেকে বের হয়ে আসার পর কথা হয় উপজেলার পালশা গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, চার বিঘায় তিনি ধান চাষ করেছেন। ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মজুরিতে শ্রমিক নিয়ে ধান কেটে ৭০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করেছেন। এখানে ভাড়াভিত্তিক যন্ত্র সেবাকেন্দ্রের সাইনবোর্ডই শুধু দেখেন। কোনো দিন কেউ তাদের বলেনি, যে এখানে ধান কাটার যন্ত্র ভাড়া পাওয়া যায়। এই যন্ত্র ৭০০ টাকায় এক বিঘা জমির ধান কেটে দেয় এমন তথ্য শুনে তিনি আফসোস করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চারঘাট উপজেলার যন্ত্রটি আমন কাটার পর থেকে নষ্ট পড়ে ছিল। সম্প্রতি ঠিক করা হয়েছে। দুর্গাপুরের যন্ত্রটি চালক চলে যাওয়ার পর অব্যবহৃত পড়ে ছিল। পরে চালক হিসেবে আরেকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ঝড়ে ধান নুয়ে পড়ায় গোদাগাড়ীতে যন্ত্রটি দিয়ে কাজ করা যায়নি বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে।

অধিদপ্তরের রাজশাহীর উপপরিচালক শামছুল হক বলেন, পবায় প্রায় ৮০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন জমিগুলোতে এই যন্ত্র নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। ঝড়ে নুয়ে পড়া ধানগাছ থেকে যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা কষ্টকর। যন্ত্র দিয়ে কাটলে খড় আলাদা করে পরে সংগ্রহ করতে হয়। এটাকে অনেক কৃষক সমস্যা মনে করছেন। এ ছাড়া চালক এবং যন্ত্র ঠিক করার কারিগরের সংখ্যা সীমিত। এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর সুফল পাওয়া যাবে এবং জনপ্রিয়তা বাড়বে। জেলার বাইরে ভাড়া দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি জেলার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা নয়।