সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র বেপরোয়া

  • চক্রের সদস্যরা মাদক বিক্রি ও সেবন, সীমান্তে চোরাচালান, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, বালুমহালের নিয়ন্ত্রণের মতো অপরাধে জড়িত।

  • স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার প্রশ্রয়ে এরা বেপরোয়া।

প্রতীকী ছবি

নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা সদরে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্কুলছাত্র আসিফের ওপর হামলার ঘটনাটি বেশ আলোচিত। সেদিন সন্ধ্যায় আসিফকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে দুই পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছিল। একটি কিশোর গ্যাং বা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছিল। ওই চক্রে যোগ না দেওয়াই ছিল আসিফের অপরাধ।

আসিফের বাবা দুর্গাপুর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নাজমুল শাহদাত। তিনি বলছিলেন, ছেলের চিকিৎসা করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু কোনো বিচার পাননি।

দুর্গাপুরে আকাশ ও পরশ গ্রুপ নামে দুটি বড় সংঘবদ্ধ কিশোর অপরাধী চক্র রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় আকাশ ও পরশ গ্রুপ নামে দুটি বড় সংঘবদ্ধ কিশোর অপরাধী চক্র রয়েছে। গত এক বছরে উপজেলার অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী দুই পক্ষের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই অপরাধী চক্রগুলো মাদক বিক্রি ও সেবন, চুরি, সীমান্তে চোরাচালান, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, বালুমহাল ও অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণের মতো অপরাধে জড়িত। স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার প্রশ্রয়ে এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

দুর্গাপুরে কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধের চিত্র বেরিয়ে আসে দুই বছর আগে একটি খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর পরশ গ্রুপের হামলায় আহত হয়ে মারা যান উপজেলা ‘নবীন লীগে’র ‘স্বঘোষিত’ সভাপতি কাওসার তালুকদার। কাওসার হত্যায় পরশের চাচাতো ভাই সাহসের গ্রুপও জড়িত ছিল। পরশের বিরুদ্ধে হত্যাসহ তিনটি এবং সাহসের বিরুদ্ধে হত্যাসহ সাতটি মামলা রয়েছে।

এখন দুর্গাপুরের সবচেয়ে আলোচিত কিশোর গ্যাংয়ের নাম ‘আকাশ গ্রুপ’। এই গ্রুপে ৫০ জনের বেশি কিশোর ও তরুণ আছে। আকাশের বড় ভাই ইলিয়াস তালুকদার ও চাচাতো ভাই আলম তালুকদারও এই গ্রুপে রয়েছেন। তাঁদের দুজনের বয়স পঁচিশের ওপরে।

আকাশ দুই মামলার আসামি। আলম তালুকদারের বিরুদ্ধে থানায় মামলা আছে পাঁচটি। আলম তালুকদার দাবি করেন, তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার কুমৎগঞ্জ বাজারের আধিপত্য নিয়ে আকাশ গ্রুপের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলা উদ্দিন আল আজাদের ছেলে ও নাতিদের প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আলা উদ্দিন আল আজাদ বলেন, ‘আমি নিজেই নির্যাতিত। কিছু বলব না। আপনারা খোঁজ নেন। কারা কিশোর গ্যাং চালায়।’

দুর্গাপুর বাজারের সাধারণ দোকানদার, পরিবহন ব্যবসায়ী, শিক্ষকসহ অন্তত আটজন আকাশ গ্রুপের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন বলে এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, এই সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রটি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস তালুকদারের প্রশ্রয় পাচ্ছে।

তবে উপজেলা চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস দাবি করেন, আলম ও আকাশ চাচাতো ভাই হলেও তাঁর বাড়িতে ঢুকতে পারেন না। এ ছাড়া আকাশ একটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। সে সময় তিনি প্রশাসনকে আকাশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন।

সক্রিয় অন্য অপরাধী চক্রও

কিশোর অপরাধী চক্রের বাইরে দুর্গাপুরে সাদ্দাম, মাজহারুল ও শামীম ওরফে শুটার শামীম গ্রুপ নামে তিনটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র আছে। এরা মাদক, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, বালুমহালের নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।

সাদ্দাম হোসেন উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক, চাঁদাবাজিসহ সাতটি মামলা রয়েছে। তবে সাদ্দামের দাবি, তাঁর সঙ্গে অপরাধী নেই।

মাজহারুল ইসলাম উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি। তাঁর নামে মামলা আছে পাঁচটি। শামীম হোসেন ওরফে শুটার শামীম বিএনপির রাজনীতি করেন। তিনি মাদক, অস্ত্রসহ ১০ মামলার আসামি।

দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া ইউনিয়নের শিবগঞ্জ বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, তাঁরা দা মজিবরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। মাদক, চোরাচালান ও অটোরিকশায় চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় শিবগঞ্জ বাজারের অন্তত ১০ জন ব্যবসায়ী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত ১২ ‍ডিসেম্বর নলজোড়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নুর ইসলামকে টেঁটা দিয়ে আঘাত করেন দা মজিবর। এই মামলায় মজিবর ১৮ দিন জেল খাটেন। বর্তমানে জামিনে আছেন।

নাগরিক সমাজের কেউ কেউ মনে করেন, অপরাধ ঠেকাতে পুলিশ প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে। পুলিশ শক্ত অবস্থান নিলে অপরাধীরা এতটা সাহস পেত না।

তবে পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসীর বলেন, দুর্গাপুরে চোরাচালান ও অপরাধ ঠেকাতে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। এরপরও দু–একটা যে ঘটে না, তা নয়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয় বলে তাঁর দাবি। (শেষ)